দলবদলের হিড়িক ও বিকল্পের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গ

ক্ষমতায় এসে মমতা ব্যানার্জির সরকার কৃষি সমবায়গুলোসহ প্রায় ২০ হাজার সমবায় সরকারি অধ্যাদেশ জারি করে বেমালুম বাতিল করে দেয়।


ভোটের ঢাকে কাঠি পড়তেই দলবদলের হিড়িক। সকালে তৃণমূল। বিকেলে বিজেপি। একই উঠোনের দুই দালান। তৃণমূলের সাবেকদের নিয়ে গঠিত বিজেপির রাজ্য কমিটি। আর তৃণমূলের রাজ্য কমিটিতে বিজেপির গন্ধ। বিজেপির সবচেয়ে বড় সাপ্লাই লাইন তৃণমূল। রাতারাতি তৃণমূলের দলীয় দপ্তরে বিজেপির ব্যানার। সন্ধ্যায় চ্যানেলে চ্যানেলে তার মুখরোচক খবর। সকালের দৈনিকে পাতাজোড়া শিরোনাম। দলবদলের তরজা। আর এই বাহারি প্রচারের আতিশয্যে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যা।

রাজ্যের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। গত নয় বছরে এই সরকার নতুন করে ধার নিয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। রাজ্যের ১০ কোটি মানুষের মাথায় ধার এখন ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এই ধারের অর্থ দিয়ে কী করেছে সরকার? পরিকাঠামো উন্নয়ন? রাস্তা-ঘাট-পানীয় জল-সেচ-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বানানোর জন্য কি এই অর্থ খরচ করেছে? এককথায়—না। রেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, কৃষকদের ফসল উৎপাদনের দেড় গুণ দাম দেওয়া বা অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বার্ধক্য ভাতার পরিমাণ ও সংখ্যা কি বেড়েছে? তাও নয়। তাহলে কী করেছে এই অর্থ দিয়ে?

রাজ্যে নিয়োগ বন্ধ স্কুল সার্ভিস কমিশন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুর্নীতির জন্য হাইকোর্টের রায়ে আপার প্রাইমারিতে মেধাতালিকা সম্পূর্ণ বাতিল। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে পঙ্গু করে হয়েছে নতুন বোর্ড, যা সংবিধানসম্মত নয়। দুর্নীতি, নৈরাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনে।

বেপরোয়া সরকারি অর্থ লুট, মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের থেকে নীল–সাদা রং কেনা, ক্লাবে-উৎসবে দেদার টাকা ওড়ানো, ইমাম-মুয়াজ্জিন-পণ্ডিতদের অনুদান, আজ মাটি মেলা, কাল সমুদ্র মেলা, পরশু পিঠা মেলা—এই হলো সরকারের কাজ। এই সময়ে রাজ্যে একটা কারখানা নতুন করে হয়নি। উল্টো বাম আমলে তৈরি বহু কারখানা বা কোম্পানি তোলাবাজির অত্যাচারে রাজ্য থেকে চলে গিয়েছে। গ্রামে প্রকল্পের টাকা লুট হচ্ছে, গরিব মানুষ কাজ পান না। লাখো কোটি বেকার কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছেন। তাঁদের বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তান পথ চেয়ে বসে আছেন।

রাজ্যে নিয়োগ বন্ধ স্কুল সার্ভিস কমিশন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুর্নীতির জন্য হাইকোর্টের রায়ে আপার প্রাইমারিতে মেধাতালিকা সম্পূর্ণ বাতিল। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে পঙ্গু করে হয়েছে নতুন বোর্ড, যা সংবিধানসম্মত নয়। দুর্নীতি, নৈরাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনে। হয়নি ক্লার্কশিপ পরীক্ষা। তাহলে কোথায় হবে কর্মসংস্থান? রাজ্যে বেড়েই চলেছে শূন্যপদের সংখ্যা। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে লক্ষাধিক। কলেজের স্থায়ী অধ্যাপক ২৫ হাজারের বেশি। সরকারি-আধা সরকারি মিলিয়ে শূন্য পদ কমবেশি সাড়ে পাঁচ লাখ।

বামপন্থীরা বলছেন বিকল্পের কথা। বিকল্পের দাবিতে যে সংগ্রাম, বিকল্প সরকার হলে তার রূপায়ণ। বিকল্পের সংগ্রামে, বিকল্প সরকারের লক্ষ্যে স্লোগান হোক: কাজ, কর্মসংস্থান। কাজ দিতে না পারলে ভাতা। অতীতের মতো ফিবছর টেস্ট, এসএসসি, পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ। অবিলম্বে শূন্য পদ পূরণ। ছোট-মাঝারি শিল্পে সরকারি সহায়তা, বিনিয়োগ।

রাজ্যের মানুষ বিকল্প খুঁজছেন। মানুষ অতিষ্ঠ তৃণমূলের অত্যাচার আর লুটের রাজত্বে। বামফ্রন্টের সময় ছোট-মাঝারি শিল্পে কর্মসংস্থান ছিল রাজ্যগুলোর মধ্যে শীর্ষে। অনেক পেছনে গুজরাট। এখন সবই সংকটে। বেশির ভাগই বন্ধ। সিঙ্গুরে ৯০ শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়া কারখানা তাড়ানোর পর আর বিনিয়োগ আসেনি। জিন্দাল ইস্পাত কারখানা পুরোপুরি বন্ধ। বছর বছর শিল্প সম্মেলন হয়েছে। বিনিয়োগ হয়নি।

রাজ্যের মজুরির হার দেশের তুলনায় বেশ কম। অবধারিত পরিণতি রাজ্য ছেড়ে শ্রমিকদের ভিন রাজ্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়া। কেরালায় একজন অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি দিনে ৭০০ টাকা। আর ছুতোর, রাজমিস্ত্রির মতো দক্ষ শ্রমিকের মজুরি দিনে ১ হাজার টাকার ওপরে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে একজন অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি দিনে ৩২৯ টাকা, আর দক্ষ শ্রমিকের ৩৯৮ টাকা।

কৃষি থেকে কৃষক উচ্ছেদ রোধে চাই পরিকল্পিত উদ্যোগ। ২০১৮-১৯ সালে রাজ্যে কৃষিতে নিযুক্ত রয়েছেন ৩৪ শতাংশ কর্মরত মানুষ, ভারতের ক্ষেত্রে যে সংখ্যা প্রায় ৪৩ শতাংশ। আবার রাজ্য সরকার কৃষকদের ব্যাপক আয় বেড়েছে বলে দাবি করলেও আসলে পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের আয় ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই কম। কৃষকের অভাবী বিক্রি। আত্মহত্যা।

চাষকে লাভজনক করতে সরকারের তরফে জরুরি হলো সার ও সেচের জলের প্রসার। কৃষকের জন্য কেবল এককালীন ঋণ মওকুফ নয়। ফসলের দেড় গুণ দামের নিশ্চয়তা। কৃষি থেকে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। যাতে নিশ্চিত করা যায় ফসলের দাম। ছোট-মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ, যাতে মূল্য যোগ করা যায় কৃষি ফসলে। সেই সঙ্গে ভূমি সংস্কারে জমি পাওয়া যাঁরা উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

সেই সঙ্গেই এপিএমসি অ্যাক্ট বাতিল। মাঠে ফসল থাকাকালেই বেসরকারি সংস্থা যাতে কৃষকদের কাছ থেকে তা কিনে নিতে পারে, সে জন্য মোদির ছয় বছর আগেই ২০১৪ সালে আইন পাস করেছে তৃণমূল সরকার। কৃষিপণ্যের বাজারে খুলে দিয়েছে বৃহৎ পুঁজি প্রবেশের পথ। এই আইনে যেকোনো ব্যক্তি, কোম্পানি, সংস্থা, কো-অপারেটিভ সোসাইটি, সরকারি সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা অথবা এজেন্সিকে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কেনার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই আইনেই ‘কমিশন এজেন্ট’ নিয়োগের অধিকারও দেওয়া হয়েছে ক্রেতাকে। অর্থাৎ আইনেই দালালি ব্যবস্থাকে দেওয়া হয়েছে বৈধ স্বীকৃতি। ২০১৭, একটি সংশোধনী এনে কৃষিপণ্যের ই-ট্রেডিং বা অনলাইন বাণিজ্য এবং বিপণনও বৈধ করেছে।

ক্ষমতায় এসে মমতা ব্যানার্জির সরকার কৃষি সমবায়গুলোসহ প্রায় ২০ হাজার সমবায় সরকারি অধ্যাদেশ জারি করে বেমালুম বাতিল করে দেয়। এর ফলে সমগ্র বাজার চলে যায় কিছু অর্থবান ক্ষমতাশালী দালালের নিয়ন্ত্রণে।

বামফ্রন্টের আমলে গড়ে উঠেছিল কয়েক হাজার কৃষি সমবায় সংস্থা। স্থানীয় কৃষকেরাই সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই সমবায়গুলোই কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে সরকারের কাছে সরাসরি বিক্রি করত। এই ব্যবস্থা কৃষকদের সরাসরি সরকারি সহায়তা মূল্য পেতে সাহায্য করত। ক্ষমতায় এসে মমতা ব্যানার্জির সরকার কৃষি সমবায়গুলোসহ প্রায় ২০ হাজার সমবায় সরকারি অধ্যাদেশ জারি করে বেমালুম বাতিল করে দেয়। এর ফলে সমগ্র বাজার চলে যায় কিছু অর্থবান ক্ষমতাশালী দালালের নিয়ন্ত্রণে। এরপর ২০১৭ সালে এপিএমসি আইনের পরিবর্তন করে রাজ্যের কৃষিপণ্যের বাজার ও বিপণনকে সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন তিনি।

জরুরি হলো সব গ্রাম ও শহরে রেগা প্রকল্পে কাজের নিশ্চয়তা। ১০০ দিন না। ২০০ দিন। একই সঙ্গে জরুরি খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্ব। গণবণ্টনের সম্প্রসারণ। আগের সব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তাকে সময়োপযোগী করা। সব মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয় জল। বাসস্থানের ব্যবস্থা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সর্বজনীন শিক্ষা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈরাজ্যের অবসান। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা।

সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সবটাই করা দরকার বিনা মূল্যে। জনস্বাস্থ্যে সরকারকে নিতে হবে সম্পূর্ণ দায়িত্ব। মহামারি ও রোগ প্রতিরোধে দিতে হবে অগ্রাধিকার। বিদ্যুতে ক্রস সাবসিডি বা পারস্পরিক ভর্তুকির মারফত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য বিদ্যুতের দাম কমানো।

সম্পদের বণ্টনের জন্য যে স্টেট ফিন্যান্স কমিশন ছিল, তাকে পুনরুজ্জীবিত করে প্রয়োজন সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ। রাজ্য সরকার পরিচালিত রুগ্‌ণ সংস্থাগুলোর পুনরুজ্জীবনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ। সরকারি কারখানা তৈরি সামগ্রী বিপণনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। চা–বাগানের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ। চটকল ও পাটচাষিদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ।

পরিবেশ রক্ষার জন্য বনাঞ্চল সংরক্ষণে বিশেষ প্যাকেজ। বেআইনি খনি, খাদান বন্ধ করা। বড় শহরগুলোয় সরকারি পরিবহনের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ–চালিত বাস ও অন্যান্য যানবাহন তার জন্য বিশেষ অগ্রাধিকার। স্পেশাল গ্রিন জোন নির্মাণ ও সংরক্ষণের উদ্যোগ। নারী নির্যাতন, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স প্রতিরোধে শহরে ওয়ার্ড বা বরোভিত্তিক বিশেষ সহায়তা কেন্দ্র। গ্রামবাংলায় ব্লক-স্তরে। ট্রান্সজেন্ডার মানুষের জন্য হরাইজন্টাল রিজার্ভেশন।

সংগঠিত শিল্পে এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য বার্ধক্যকালীন, কাজের সময় দুর্ঘটনা, কাজের ধরনের জন্য স্বাস্থ্যহানির জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষ তহবিল গঠন। উন্নয়নের কাজে গ্রামসভা থেকে ওয়ার্ডসভায় মানুষের অংশগ্রহণ। সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে পাহাড়ে সর্বোচ্চ স্বশাসনের অধিকার। গণতন্ত্রে বিরোধী রাজনৈতিক মতের অধিকার। শান্তিতে ভোটদানের অধিকার। পঞ্চায়েত, পৌরসভায় নিয়মিত অবাধ নির্বাচন। গুন্ডারাজ, তোলাবাজমুক্ত রাজ্য।

শান্তনু দে পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক