দারুচিনি দ্বীপ আজ বিপর্যস্ত

সুন্দর এই ‘দারুচিনি দ্বীপ’ আজ অশান্ত, বিপর্যস্ত, অসহায়

ছেলেবেলায় ‘সিংহল’ নামে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতা পড়েছিলাম। তার কয়েকটি লাইন এখনো মনে মনে আওড়াই, যখন শ্রীলঙ্কা সংবাদ শিরোনাম হয়। সিংহল নামটি বাঙালির দেওয়া। ইংরেজরা উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছিল সিলোন। পরে স্বাধীন দেশের সরকার ইতিহাস-পুরাণ ঘেঁটে শ্রীলঙ্কা নাম রেখেছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে মুগ্ধতা:

ওই সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ কাঞ্চনময় দেশ!

ওই চন্দন যার অঙ্গে বাস, তাম্বুল-বন কেশ!

...এই বঙ্গের বীজ ন্যগ্রোথ প্রায় প্রান্ত তার ছায়,

আজো বঙ্গের বীর ‘সিংহে’র নাম অন্তর তার গায়।...

‘বঙ্গের বীর সিংহ লংকা হেলায় করিল জয়’—এ রকম কথা আছে। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট জয়াবর্ধনে ঢাকায় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বলেছিলেন, তাঁদের দেশ একসময় ছিল বাংলার উপনিবেশ। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে আছে। বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের ছাত্র আনন্দ সামারাকুনের লেখা ‘নমো নমো মাতা’ গানটি এখন তাঁদের জাতীয় সংগীত। কেউ কেউ বলেন, এটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখা। এই তথ্যের কোনো সত্যতা নেই।

ইংরেজ আমল থেকেই শ্রীলঙ্কায় শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপক প্রসার হয়। সব সূচকেই তারা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব দেশ থেকে এগিয়ে ছিল। পরপর দুটি ‘রাজনৈতিক দুর্যোগে’ তারা পিছিয়ে পড়ে। তা না হলে তাদের সিঙ্গাপুর বা হংকং থেকে পিছিয়ে থাকার কোনো কারণ ছিল না। প্রথম দুর্যোগটি ঘটে ১৯৭১ সালের এপ্রিলে। বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তখন ২৮ বছরের তরুণ রোহান বিজেবীরার নেতৃত্বে ‘জনতা বিমুক্তি পেরামুনা’ (পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট) একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটায়। দলটি ছিল পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে আসা একদল তরুণের। তাঁরা একে একে ৭৫টি থানা দখল করে নেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁরা উত্তর কোরিয়া ছাড়া বিদেশি আর কারও সহানুভূতি পাননি। অভ্যুত্থান দমনে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দেয় ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া ও চীন। ফলে শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের সরকার টিকে যায়। অসংখ্য বিপ্লবী নিহত ও গ্রেপ্তার হন।

দ্বিতীয় দুর্যোগটি ছিল জাতপাতের দ্বন্দ্ব—সিংহলি বনাম তামিল। তামিলরা সংখ্যায় কম, জনসংখ্যার মাত্র ১৮ শতাংশ। কিন্তু লেখাপড়ায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা ছিল অনেক এগিয়ে। ফলে জন্ম নিল সিংহলি জাতীয়তাবাদ। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের অনিবার্য ফল হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ১৯৮৩ সালে এ রকম একটি দাঙ্গায় কলম্বো শহরে তামিল মালিকানাধীন অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ও রেস্টুরেন্ট পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই) সিংহলি শভিনিজমের বিরুদ্ধে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তামিল-অধ্যুষিত অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন শুরু করে। একপর্যায়ে তারা পায় প্রতিবেশী ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের মানুষের সহানুভূতি এবং ভারতের সামরিক ও আর্থিক সাহায্য। ২৫ বছর ধরে চলে তাদের ‘গৃহযুদ্ধ’ বা মুক্তিযুদ্ধ—যে নামেই বলা হোক না কেন। একপর্যায়ে ভারত সরে দাঁড়ায়। ২০০৯ সালে সরকারি বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে এলটিটিই পর্যুদস্ত হয়। বন্দী অবস্থায় নিহত হন প্রভাকরণ। দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধে শ্রীলঙ্কার পর্যটন, কলকারখানা, কৃষি অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে। শুরু হয় অর্থনৈতিক দুর্যোগ।

ঘোরতর আর্থিক মন্দার কবলে পড়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। এলটিটিই যুদ্ধে পরাস্ত হলেও দ্বন্দ্ব এখনো জ্বলছে ধিকিধিকি করে। এক দিনে এই সংকট তৈরি হয়নি। কিছুটা বিরতি দিয়ে ৭০ বছর ধরে শ্রীলঙ্কা শাসন করছে দুটি পরিবার—বন্দরনায়েকের পরিবার আর রাজাপক্ষের পরিবার। পারিবারিক শাসনে গণতন্ত্র থাকে না। তৈরি হয় পরিবারতন্ত্র। যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এ ধরনের সরকার চারটি কাজ করে—এক. ক্ষমতার ভিত হিসেবে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আমলাদের ওপর নির্ভর করে তাদের শক্তি বাড়িয়ে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো; দুই. উন্নয়নের ঢাক পিটিয়ে যথেচ্ছ বৈদেশিক ঋণ নিয়ে প্রকল্প বানানো; তিন. স্বজনপ্রীতি অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে জনগণের টাকায় আত্মীয় ও মোসাহেব তোষণ; এবং চার. জনবিক্ষোভ যাতে না হয়, এ জন্য নানা রকম কালাকানুন তৈরি করা।

একসময় শ্রীলঙ্কার নাগরিক সমাজ ছিল খুবই গতিশীল ও সক্রিয়। কিন্তু নানা আইনের ফাঁদে পড়ে তারা অনেকেই গ্রেপ্তার, গুম, নিশ্চুপ হয়ে গেছে অথবা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু এতসব করেও শেষ রক্ষা হয়নি। জনরোষ বিস্ফোরিত হয়েছে। আন্দোলনের চাপে পড়ে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে একটি নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর ভাই, যিনি এখন প্রেসিডেন্ট, তাঁর পদত্যাগের দাবি দিন দিন জোরদার হচ্ছে। দেয়ালের লিখন পড়তে পেরে অনেক মন্ত্রী-এমপি ও তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গরা পালাচ্ছেন। পলায়মান অনেককে ধরে জনতা উত্তমমধ্যম দিচ্ছে, কাপড় খুলে নিচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার এই দশা দেখে বাংলাদেশে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতণ্ডাও হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক দায়দেনা শোধ করার ক্ষমতা নেই। গত বছর এটা ছিল তাদের জাতীয় আয়ের চার গুণ। অর্থাৎ তাদের যে জাতীয় আয়, তার চার গুণ টাকা ঋণের কিস্তি ও সুদ হিসেবে ফেরত দিতে হবে। সরকার গত বছরেই নিজেদের এ ব্যাপারে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশের দায়দেনা শোধের বর্তমান হার এখনো সহনীয়। কিন্তু যেভাবে উচ্চ সুদে দ্বিপক্ষীয় সূত্র থেকে ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প বানানো হচ্ছে, শিগগিরই তার কিস্তি ও সুদ গুনতে হবে। তখন রাষ্ট্রীয় তহবিলের ওপর চাপ বাড়বে। আমাদের তো বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস দুটি—শ্রমিকের রেমিট্যান্স আর তৈরি পোশাক রপ্তানি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনো অঘটন ঘটে গেলে বা দুর্যোগ নেমে এলে আমাদের এই উৎসগুলোর হুমড়ি খেয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। ইউক্রেন নিয়েই দুনিয়াজুড়ে যে শোরগোল হচ্ছে, তাতে স্বস্তিতে থাকার সুযোগ নেই।

আমরা রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নিঃসন্দেহে অনেক অপচয় করি। প্রশ্ন উঠেছে, এত খরচ করে সড়ক-সেতু পৃথিবীর আর কোনো দেশে তৈরি হয় না। শুনতে পাচ্ছি, অনেকগুলো সেতু নাকি নৌ-চলাচলের জন্য ভেঙে ফেলতে হবে। কিছু উড়ালসেতুও নাকি ভাঙতে হতে পারে। এসব প্রকল্প তো একনেকেই পাস হয়। আজ পর্যন্ত কেউ কি স্বীকার করেছেন যে ‘আমরা এই প্রকল্প নিয়ে ভুল করেছি’। এক দলের সরকার অন্য দলের সরকারের আমলে নেওয়া প্রকল্পকে ভুল বলে, কিন্তু নিজেদের ব্যাপারে সব সময় সাফাই গায়। সরকার বদল না হলে আমরা এসব জানতেই পারি না।

জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব এবং ধারাবাহিকভাবে উল্টাপাল্টা প্রকল্প নেওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কা আজ পথে বসেছে। সুন্দর এই ‘দারুচিনি দ্বীপ’ আজ অশান্ত, বিপর্যস্ত, অসহায়। আমরা তুলনামূলকভাবে ভালো আছি। কিন্তু আত্মপ্রসাদের ঢাক না পিটিয়ে শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

[email protected]