দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে হবে

পাঠক, আপনি কি জানেন, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ মুক্ত গণমাধ্যমের জমানায় বসবাস করে? ২০১৬ সালের গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক ফ্রিডম হাউসের এক প্রতিবেদন অনুসারে, এই ১৩ শতাংশ মানুষের বসবাসের জায়গায় সাংবাদিকদের নিরাপত্তা আছে। আর বিশ্বের ৪১ শতাংশ মানুষ এমন জমানায় বসবাস করে, যেখানে গণমাধ্যম আংশিকভাবে স্বাধীন। ৪৬ শতাংশ মানুষের দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) সম্প্রতি দাবি করেছে, বিশ্বের যে ১৩টি দেশ সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক, তার মধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত আছে। এই তালিকার অন্য দেশগুলো হচ্ছে সোমালিয়া, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিপাইন, দক্ষিণ সুদান, মেক্সিকো, ব্রাজিল, রাশিয়া ও নাইজেরিয়া।
সিপিজের ২০১৬ সালের গ্লোবাল ইমপিউনিটি ইনডেক্সে ওই দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেখানে সাংবাদিকদের কতল করেও অপরাধীরা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। আজ ২ নভেম্বর হচ্ছে এই দায়মুক্তি অবসানবিষয়ক আন্তর্জাতিক দিবস। এ বছর ইউনেসকোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম, যেমন ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড, আইএফজে, সিপিজে ও আরএসএফ এই দায়মুক্তির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।
ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসবাদ ও গণতান্ত্রিক সরকারের অসহিষ্ণুতা দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। কিছু কিছু দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে গণমাধ্যমের কণ্ঠ স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে। তুরস্কের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের নজির দেওয়া যায়। সেখানকার গণতান্ত্রিক সরকার ‘গণতন্ত্র রক্ষার’ নামে গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, গণমাধ্যম মুসলিম দেশগুলোতে দ্রুত স্বাধীনতা হারাচ্ছে। তবে এখন ইউরোপও এই কাতারে যোগ দিয়েছে। ইউরোপে যে রকম গণহারে অভিবাসীরা ঢুকছে, তাতে নানাভাবেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। যেমন হাঙ্গেরির কথাই বলা যায়। সেখানকার সাংবাদিকেরা অভিবাসীদের সঙ্গে দাঙ্গা পুলিশের মারামারির প্রতিবেদন করতে গেলে পুলিশ তাঁদের ওপর আক্রমণ করে। আবার জার্মানির কিছু অতি ডানপন্থী গোষ্ঠীও সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে, যারা অভিবাসীদের বিষয়ে মেরকেলের উদার নীতির বিরোধী।

>বর্তমানে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা চলছে। কিন্তু একটি ব্যাপারে তারা এক। তারা সব সময় একে অপরের বিরুদ্ধে পোষ মানা গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে চায়

আমি যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ, তাই আমি এ অঞ্চলের গণমাধ্যমের ওপর হুমকির ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতে তো গণতন্ত্র আছে, কিন্তু এই দেশগুলো গণমাধ্যমের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে কেন? সন্ত্রাসবাদই এর একমাত্র কারণ নয়। অপরাধী ও দুর্নীতিবাজ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করা কঠিন হয়ে গেছে। আসলে ব্যাপারটা হয় কী, যাঁরা ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে থাকেন, তাঁরা কখনো কখনো ভিন্নমত পছন্দ করেন না। তাঁরা সাংবাদিকদের দেশবিরোধী আখ্যা দিয়ে চুপ করিয়ে দিতে চান। আমি বিশ্বাস করি, সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
কথা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সুশাসন ছাড়া টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। আর গণমাধ্যম যদি কিছু ন্যায্য প্রশ্ন তুলতে না পারে, তাহলে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতে অনেক সাংবাদিক মারা গেছেন, কিন্তু তাঁদের খুনিরা গ্রেপ্তার হয়নি। ২০০৫ সালের পর পাকিস্তানের ১০০ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী জীবন হারিয়েছেন। অর্থাৎ, প্রতি মাসে প্রায় একজন করে মারা গেছেন। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র দুটি মামলার রায় হয়েছে। এ বছরের এপ্রিলে পাকিস্তানের সাংবাদিক হাফিজ হুসনাইন রাজাকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারণ, তিনি এক কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে লিখেছিলেন, যারা নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। পাকিস্তানের গণমাধ্যম দ্রুত স্বাধীনতা হারাচ্ছে। দেশটির তথ্যমন্ত্রী পারভেজ রশিদকে বারখাস্ত করা হয়েছে। ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক, কারণ অভিযোগ হচ্ছে, তিনি সেনাবাহিনী ও সরকারের মধ্যকার দ্বন্দ্বের খবর ফাঁস হওয়া রোধ করতে পারেননি। ওদিকে ওই খবর ফাঁসকারী সিরিল আলমেইদা দেশ ছেড়েছেন, কারণ রাজনীতিকেরা দাবি করছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা করা হোক।
ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। দেশটির বিচার বিভাগ শক্তিশালী, গণমাধ্যমও গতিশীল। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর দেশটির ৯৫ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। খুব কম মামলারই রায় হয়েছে। ২০১৫ সালে উত্তর প্রদেশের পুলিশ সাংবাদিক জগেন্দ্র সিংয়ের গায়ে আগুন দিয়ে মেরে ফেলেছে। অভিযোগ ছিল, তিনি এক স্থানীয় মন্ত্রীর কথিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। কারও বিচার হয়নি। এদিকে কয়েক সপ্তাহ আগে শ্রীনগর থেকে প্রকাশিত ডেইলি কাশ্মীর রিডার বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে সবক নিতে চায়নি। বাংলাদেশের অনেক উদার সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও অপরাধমূলক ও দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হচ্ছে।
দায়মুক্তিবিষয়ক ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট ২০১৬-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গণমাধ্যম-সংক্রান্ত প্রতি ১০টি মামলার মধ্যে একটি মামলার তদন্ত হয়। আইএফজের দায়মুক্তি অবসান ২০১৬ প্রচারণায় প্রতিটি দেশকে দায়মুক্তির জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু তারা সুনির্দিষ্টভাবে চারটি দেশের ওপর জোর দিচ্ছে: মেক্সিকো, পাকিস্তান, ভারত ও ইয়েমেন। বর্তমানে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা চলছে। কিন্তু একটি ব্যাপারে তারা এক। তারা সব সময় একে অপরের বিরুদ্ধে পোষ মানা গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে চায়। তারা যদি মনোভঙ্গি পরিবর্তন করে গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দেয়, তাহলে উভয় দেশের সাংবাদিকেরাই উত্তেজনা হ্রাসে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন। মুক্ত গণমাধ্যমই কেবল পৃথিবীতে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি বয়ে আনতে পারে। আর এই স্বাধীনতার পথে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে দায়মুক্তির অবসান ঘটানো। আসুন, আমরা সবাই একত্রে এই দায়মুক্তির বিরুদ্ধে জোরে কণ্ঠ ছাড়ি।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
হামিদ মির: পাকিস্তানি সাংবাদিক।