দিনের ভোটও কি দেখেছেন সিইসি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) খন্দকার মোহাম্মদ নূরুল হুদা গত বৃহস্পতিবার বিদায়ী ভাষণে অনেক কথা বলেছেন। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি এ কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি নতুন কমিশন দায়িত্ব নেবে। বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে ‌রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি) আয়োজন করে ‘আরএফইডি টক উইথ কে এম নূরুল হুদা’। ধারণা করি, সাংবাদিকদের সঙ্গে বড় পরিসরে এটাই তাঁর শেষ টক বা আলোচনা।

এ আলোচনায় সিইসি নূরুল হুদা এমন কতগুলো কথা বলেছেন, যা আগে বলেননি। যেমন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনেছেন। অভিযোগ এনেছেন নাগরিকদের জন্য সুশাসন (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বিরুদ্ধেও। তিনি নাকি নির্বাচন কমিশন থেকে অর্থ নিয়ে কাজ করেননি। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সবক দেওয়াও ভালো লাগেনি হুদা সাহেবের। তিনি গুরুতর অভিযোগ করেছেন কমিশনের অন্যতম সদস্য মাহবুব তালুকদারের বিরুদ্ধেও। মাহবুব তালুকদারের চিকিৎসার জন্য কমিশন থেকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে, সেই বয়ানও দিয়েছেন সিইসি। এসব অভিযোগের বিষয়ে আশা করি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জবাব দেবেন।

তবে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন যে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করে দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে, বর্তমান সিইসি তা মেনে নিতে পারেননি। তিনি উষ্মার সঙ্গে বলেছেন, বন্দুকের নলের মুখে একবারই নির্বাচন করা যায়, বারবার সেটি সম্ভব নয়। এর মাধ্যমে তিনি কি তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে সেনাসমর্থিত সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সেটি সহজ নয়? হুদা সাহেব নিজেই বলেছেন কাজটি করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন হলো, কোন দল জিতল বা হারল সেটি, ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়া।

এরপর দেখা যাক ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে সিইসি কী বলেছেন। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল দিনের ভোট যে রাতে হয়েছে, সে সম্পর্কে তাঁরা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন। সিইসির জবাব: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলে যে অভিযোগ, তা অভিযোগ আকারেই থেকে গেছে। অভিযোগের তদন্ত আদালতের নির্দেশনা ছাড়া হয় না।...‘অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে আমি কনক্লুসিভ কিছু বলতে পারি না। কারণ, আমি তো দেখি নাই। আপনিও দেখেননি যে রাতে ভোট হয়েছে। তদন্ত হলে বেরিয়ে আসত, বেরিয়ে এলে আদালতের নির্দেশে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যেত। সারা দেশের নির্বাচনও বন্ধ হয়ে যেতে পারত। রাজনৈতিক দলগুলো কেন আদালতে অভিযোগ দেয়নি, সেটা তাদের বিষয়। এ সুযোগ তারা হাতছাড়া করেছে।’ (প্রথম আলো, ২৮ জানুয়ারি ২০২২)

রাতের ভোটের বিষয়ে মামলা না করে বিরোধী দল সুযোগ হাতছাড়া করেছে বলে সিইসি মন্তব্য করেছেন। কিন্তু আইনে বিপুল স্বাধীনতা দেওয়ার পরও তারা যে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার সুযোগ হাতছাড়া করলেন, এর জবাব কী।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা সম্ভবত দেশের সব মানুষকে গবেট ভাবেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সারা দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি কী ছিল, তা কারও অজানা নয়। নির্বাচনের আগে গায়েবি মামলা দিয়ে যে সরকার বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে (যার মধ্যে অনেক প্রার্থীও ছিলেন) দৌড়ের ওপর রেখেছিল, তাঁদের নির্বাচনী প্রচারে বাধা দিয়েছিল, হুদা কমিশন তা দেখেও না দেখার ভান করে। তাদের কাজকর্ম দেখে মনে হয়েছে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের অধীন নয়, কমিশনই প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হুকুমবরদার।

রাতের ভোটের বিষয়ে মামলা না করে বিরোধী দল সুযোগ হাতছাড়া করেছে বলে সিইসি মন্তব্য করেছেন। কিন্তু আইনে বিপুল স্বাধীনতা দেওয়ার পরও তারা যে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার সুযোগ হাতছাড়া করলেন, এর জবাব কী।

বিরোধী দলসহ বিভিন্ন মহলের আপত্তির মুখে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে যে নির্বাচন কমিশন আইন পাস হলো, তাকে স্বাগত জানিয়েছেন সিইসি। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি বলেছিলেন সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হওয়া উচিত। তাঁর মন্তব্য ছিল ‘পরবর্তী কমিশন গঠন রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। অবশ্যই এটা হওয়া উচিত। আমি এটাকে সমর্থন করি। যেন নতুন কমিশন সবার সমর্থনযোগ্য হয়, সে রকম একটি কমিশন হওয়া উচিত।’ (প্রথম আলো, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১)।

মাত্র চার মাসের ব্যবধানে তিনি নিজের অবস্থান পরিবর্তন করলেন।

উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সেই নির্বাচন নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক সমালোচনা হয়। অনেকেই অভিযোগ করেন, ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। অনেক স্থানে আগের রাতেই ভোট সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালের ৯ মার্চ নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় সিইসি নূরুল হুদা বলেছিলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না। আগে ব্যালট পেপার পাঠানোর যুক্তি তুলে ধরে কে এম নূরুল হুদা বলেন, জেলা-উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে দূরে ভোটকেন্দ্র হয়। এ কারণে আগের দিন এসব কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স পাঠাতে হয়। এখানে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু যদি ইভিএমে ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর ভোটের আগের দিন রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না (প্রথম আলো, ৯ মার্চ ২০১৯)।

তঁার সেদিনের ভাষ্য ও ২৭ জানুয়ারির বক্তব্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। ২০১৯ সালের ৯ মার্চ তিনি পরোক্ষভাবে রাতের ভোটের সত্যতা স্বীকার করে ইভিএমকে এর প্রতিষেধক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কয়েক শ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে নূরুল হুদা বলেন, ‘গেজেট হওয়ার পর বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। এর আগপর্যন্ত এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। তাই এ বিষয়ে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি, ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগও ছিল না।’ গেজেট হওয়ার আগে তিনি কিছুই জানতেন না বলে যে দোহাই দিচ্ছেন, তা ধোপে টেকে না। প্রতিটি নির্বাচনী কেন্দ্রের ফল নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়। কোন কেন্দ্রে কত ভোটার আছেন, তার হিসাবও কমিশনের কাছে থাকে। ফলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে লাভ নেই। সিইসির বক্তব্যে এই সত্যই বেরিয়ে এল যে তিনি দিনের ভোটও দেখেননি। দেখলে কোন কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, কোন কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী ছাড়া সব প্রার্থীর ব্যালট শূন্য ছিল, সে খবরও গেজেট হওয়ার আগে জানতে পারতেন। তিনি নির্বাচন কমিশনের দলিল–দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখতে পারেন, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা নির্বাচনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ায় টাঙ্গাইলের একটি উপনির্বাচনের গেজেট প্রকাশ স্থগিত রেখেছিলেন।

সিইসির বিদায়ী ভাষণের সঙ্গে আমরা মিলিয়ে দেখব অভিষেকের সময় কী বলেছিলেন। ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার সময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, আপসহীন, নিরপেক্ষ ও অটল থাকবেন; কারও দ্বারা প্রভাবিত হবেন না। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা দলবাজি করলে কঠোর হস্তে তা দমন করা হবে। এখন দেশবাসীই বিচার করুক তিনি দলবাজিকে কঠোর হাতে দমন করেছিলেন, না সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির মানমর্যাদা ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছেন?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]