দুঃখ, শোক ও বিজয়ের ডিসেম্বর

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সেটি ছিল এক অন্য রকম ডিসেম্বর। প্রতিটি মুহূর্ত ভীতিকর। রাস্তাঘাটে হোক, কর্মস্থলে হোক, ফসলের মাঠে হোক বা নিজের ঘরের ভেতরে হোক, প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুভয়। জাগ্রত অবস্থায় হোক বা ঘুমের ভেতরে হোক, প্রতিটি মানুষের বুকে যেন ঘাতকের রাইফেল তাক করা। যেকোনো সময় শরীর ঝাঁজরা হয়ে যেতে পারে। সেদিন শত্রুর হিংস্রতা ও পৈশাচিকতা সব সীমা অতিক্রম করেছিল। আজকের ডিসেম্বরে একাত্তরের ডিসেম্বরের বীভৎসতা কল্পনাও করতে পারবে না এই প্রজন্মের মানুষ।

আমাদের বয়সী আজও যাঁরা বেঁচে আছেন, ডিসেম্বর এলেই সেই ডিসেম্বরের স্মৃতি তাঁদের তাড়া করে এবং ভবিষ্যতের সব ডিসেম্বরেই করতে থাকবে। সেদিনের সেই নারকীয় নৃশংসতা থেকে মানুষ মুক্তি চেয়েছিল। শুধু মানুষ মুক্তিই চায়নি, সেই সঙ্গে ছিল তাদের স্বপ্ন, ছিল প্রত্যাশা।

সেদিনের সেই প্রত্যাশা ব্যক্তিগত প্রাপ্তির জন্য নয়—সমষ্টিগত প্রাপ্তির। সেদিন কেউ স্বার্থপরের মতো একা বাঁচতে চায়নি, সবাই মিলে বাঁচতে চেয়েছিল। সবাই যেমন ৯ মাস দুঃখ–কষ্ট ভোগ করেছে, অবস্থার পরিবর্তন হলে সবাই ভালো থাকবে। শত্রুমুক্ত স্বদেশে সবাই শুধু ভালো নয়, শান্তিতে থাকবে, সুখে থাকবে।

পৃথিবীর ইতিহাসে পাকিস্তানি জান্তার মতো হিংস্র ও নির্বোধ আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রায় সামরিক প্রশিক্ষণহীন কিশোর-যুবক গেরিলাদের কাছেই যারা নাস্তানাবুদ, তারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে কনভেনশনাল যুদ্ধ করার স্পর্ধা দেখায়। সেই যুদ্ধ তাদের ডেকে আনে মৃত্যুঘণ্টা।

অন্যদিকে শত্রুর পরিকল্পনা ছিল অন্য রকম। সেই ডিসেম্বরে দুশমন যদি আমাদের মিল–কারখানা, ব্রিজ ও রাস্তাঘাট ভেঙে দিয়ে যেত—বৈষয়িক ক্ষতি হলেও তত কষ্ট হতো না। তারা আমাদের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় মানুষদের হত্যা করেছে নির্বিচার। তা করেছে পরাজয় অবধারিত জেনে শত্রুপক্ষ ও তাদের সহযোগী বাহিনী। তা ছিল জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করে দিয়ে যাওয়ার জঘন্যতম কৌশল।

পৃথিবীর ইতিহাসে পাকিস্তানি জান্তার মতো হিংস্র ও নির্বোধ আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রায় সামরিক প্রশিক্ষণহীন কিশোর-যুবক গেরিলাদের কাছেই যারা নাস্তানাবুদ, তারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে কনভেনশনাল যুদ্ধ করার স্পর্ধা দেখায়। সেই যুদ্ধ তাদের ডেকে আনে মৃত্যুঘণ্টা। ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে মার খেয়ে করে আত্মসমর্পণের আকুল আবেদন। পৃথিবীর দুই হাজার বছরের যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাসে আর কখনো এমন অপমানকর আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেনি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের জার্মান বাহিনী ইউরোপের মিত্রশক্তির (রাশিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্স) কাছে ৮ মে ১৯৪৫ যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে, তার চেয়ে অবমাননাকর ছিল রেসকোর্স ময়দানে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ। জার্মানির নাৎসি বাহিনীর আত্মসমর্পণকে বলা হয় ‘ভিই’ বা ‘ভিক্টরি অব ইউরোপ’। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের শত্রুর আত্মসমর্পণকে আমরা বলি ‘বিজয় দিবস’—ইংরেজিতে ‘ভিক্টোরি ডে’। সে জন্য ডিসেম্বর মাসটাকেই বলি বিজয়ের মাস। ডিসেম্বর মাসটা দুঃখ ও শোকের বটে, কিন্তু সবচেয়ে গৌরবের যা তা হলো আমাদের বিজয়ের মাস।

ডিসেম্বর মাসটি একদিকে যেমন অপার দুঃখ ও শোকের স্মৃতি বহন করে, অন্যদিকে বয়ে আনে বিজয়ের আনন্দ। তবে সবচেয়ে যা বেশি প্রয়োজন তা হলো আত্মসমীক্ষা। শুধু স্বনামধন্যরা কী বলেন, তা শুনলে জাতি এগোবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হবে না। তারামন বিবি একটি প্রতীকী চরিত্র। তিনি আজ নেই। রয়েছেন দেশে লাখো তারামন বিবি। একাত্তরের রক্তসিক্ত মাটিতে কান পাতলেই তাঁদের বুকের নিঃশব্দ কথা শোনা যাবে

আড়াই হাজার বছরের মধ্যে আমাদের এই ভূখণ্ড প্রথম অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা। অতীতে কখনো কখনো বাংলা প্রায় স্বাধীন ছিল, কিন্তু সার্বভৌম ছিল না। হোসেন শাহি শাসনামলে বাংলা ৪০-৪৫ বছর একধরনের স্বাধীনতা ভোগ করেছে। নবাবি আমলেও বলতে গেলে স্বাধীনের মতোই ছিল। প্রায় স্বাধীন এবং স্বাধীনের মতো আর স্বাধীন-সার্বভৌম এক জিনিস নয়। ডিসেম্বর আমাদের উপহার দিয়েছে সেই ‘স্বাধীন-সার্বভৌম’ সত্তা।

স্বাধীন দেশের নাগরিকেরা খুব বেশি কিছু চায় না। তারা চায় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার। এ দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের জন্যই স্বাধিকার আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের প্রথমেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ‘মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবেন’। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের সময়ও নেতাদের সেই অঙ্গীকার ছিল।

১২-১৩ বছর আগে মঙ্গাকবলিত কুড়িগ্রামে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। খ্যাতিমান ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং আমাকেও সেখানে অতিথি করেন। ঘরোয়া অনুষ্ঠান নয়, মাঠের মধ্যে প্যান্ডেল করে বেশ বড় জনসভা। আমরা মঞ্চে বসা। বিভিন্ন বক্তা বক্তৃতা দিচ্ছেন। কেউ একজন বললেন, এখানে শ্রোতাদের মধ্যে তারামন বিবি রয়েছেন। অনুষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবকদের একজনকে আমি বললাম, ‘তারামন বিবিকে মঞ্চে নিয়ে আসুন।’ মঞ্চে এনে তাঁকে আমি আমার পাশে বসাই। ঘণ্টা দুই তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়। তিনি ছিলেন কিছুটা অসুস্থ এবং শরীর বেশ দুর্বল। তিনি যে বক্তৃতা দিতে পারেন, সে ধারণা আমার ছিল না। তবু তাঁকে কিছু বলার অনুরোধ করি। তিনি গিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়ান।

আমার ধারণা ছিল, তারামন বিবি মিনিট দু-তিন এলোমেলো কিছু বলবেন। কিন্তু তিনি ৩২ মিনিট বক্তৃতা করেন। কয়েক মিনিট বলার পর আমি তাঁর বক্তৃতার নোট নিতে থাকি। মানববন্ধন আর গোলটেবিলে প্রাজ্ঞ বক্তাদের ভাষণ শুনতে শুনতে কানে তালা লাগার অবস্থা, তারামন বিবির বক্তৃতায় আক্ষরিক অর্থেই অবাক হই। লক্ষ করি, জনসভার শ্রোতারাও হাঁ করে তাঁর কথা শুনছেন।

তারামন বিবি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণা করলেন মিনিট কয়েক। বললেন, তাঁর নাম ছিল অন্য, মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নাম দেন তারামন। তিনি গ্রামের পাগলি মেয়ের বেশে ক্যাম্পে যেতেন। ভাত-তরকারি রান্নায় কিছু সহযোগিতা করতেন। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা কোথায় কী অবস্থায় আছে, সে খোঁজ এনে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন।

অসামান্য বক্তা তিনি। প্রমিত বাংলায় নয়, উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায় বলে যান। তাঁর কথায় স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার একটা স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরেন। তাঁর চিন্তাজগতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। তাঁর উপলব্ধিতে বস্তুনিষ্ঠতার অভাব নেই। তিনি প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও দেখতে পেয়েছেন সুযোগ-সুবিধা দুহাতে লুটে কেউ বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা সমাজের জন্য কিছুই করেননি। বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের জীবনে আসেনি কোনো পরিবর্তন। তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। তারা সেই আগের মতোই দুর্বল ও ক্ষমতাহীন। তিনি বললেন, ‘আমারে সরকার একটা ঘর উঠাইয়া দিলে দেশের মানুষের কী লাভ?’

ডিসেম্বর মাসটি একদিকে যেমন অপার দুঃখ ও শোকের স্মৃতি বহন করে, অন্যদিকে বয়ে আনে বিজয়ের আনন্দ। তবে সবচেয়ে যা বেশি প্রয়োজন তা হলো আত্মসমীক্ষা। শুধু স্বনামধন্যরা কী বলেন, তা শুনলে জাতি এগোবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হবে না। তারামন বিবি একটি প্রতীকী চরিত্র। তিনি আজ নেই। রয়েছেন দেশে লাখো তারামন বিবি। একাত্তরের রক্তসিক্ত মাটিতে কান পাতলেই তাঁদের বুকের নিঃশব্দ কথা শোনা যাবে।


সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক