দুঃখ হয়ে ঝরতে পারে ইয়াস

১৯৯১-এর ঝড়ের পর জোয়ার আর ঘূর্ণিঝড়ের সমপাতন একসঙ্গে ঘটেনি

ইয়াস আসছে। উত্তর আন্দামান সাগরে তৈরি হচ্ছে এই ঘূর্ণিঝড়। ইয়াস মানে ‘দুঃখ’। ওমানের দেওয়া এই নামটি পারসি ভাষা থেকে এসেছে। আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা, সবকিছু ধারাপাত মেনে চললে ২৫ মে থেকে উপকূলবর্তী জেলাগুলোয় আছড়ে পড়তে পারে ইয়াস। ইয়াস কতটা তেজ আর দম নিয়ে আঘাত হানবে, এখনই হলপ করে বলা যাবে না। তবে পঞ্জিকা বলছে, ২৫ মে রাত ৮টা ৫৯ মিনিটে পূর্ণিমা তিথি শুরু হবে, চলবে ২৬ মে বিকেল ৫টা ১৩ মিনিট পর্যন্ত। পূর্ণিমায় এমনিতেই সাগরে জোয়ারের উচ্চতা অন্য সময়ের থেকে বেশি থাকে। যেমন ২১ মে ভরা জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা ছিল ৮ দশমিক শূন্য ৪ ফুট। ২৫ মে পূর্ণিমার সূচনায় সেই উচ্চতা গিয়ে দাঁড়াবে ১২ দশমিক ২৭ ফুটে আর ২৬ মে ভরা জোয়ারে তা আরও বেড়ে যাবে। ইয়াস আসুক না আসুক, পূর্ণিমার জোয়ার অন্য সময়ের থেকে ৪-৫ ফুট বেশি উচ্চতা নিয়ে আসে। আর সেই সময় যদি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে তবে সবকিছু ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।

মনে রাখা ভালো ১৯৯১-এর ঝড়ের পর জোয়ার আর ঘূর্ণিঝড়ের সমপাতন একসঙ্গে ঘটেনি। আমরা বেঁচে গেছি। পরের অনেকগুলো ঝড়েরই বেগ একানব্বইয়ের চেয়ে বেশি থাকলেও ঘূর্ণিঝড় আর জোয়ারের ক্ষণ মিলে না যাওয়ায় প্রাণহানির মাত্রা ছিল অনেক কম। সিডর, আইলায় সম্পদের ক্ষতি হলেও ‘৯১-এর তুলনায় জানের ক্ষতি কম হয়েছিল। সেটাকেই এখন আমাদের অনেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সাফল্য বলে প্রচার করে থাকেন। সন্দেহ নেই ’৯১-এর পরে আমরা অনেক এগিয়েছি, তবে আত্মতুষ্টিতে আত্মহারা হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। ঝড়ের সময় জোয়ার আসেনি।

ইয়াস কি আয়েশ করে আসবে, না চটজলদি?
অভিজ্ঞতা বলে যে কোনো ঘূর্ণিঝড় যত ধীরে ধীরে থেমে থেমে আয়াশ করে এগোয় তার ধ্বংসক্ষমতা ততই বাড়তে থাকে। এখন পর্যন্ত পূর্বাভাস অনুযায়ী দৃশ্যমান লঘুচাপটি আজ নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। পরের ৭২ ঘণ্টায় নিম্নচাপটি ধীরে ধীরে শক্তি বাড়িয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিতে পারে। সেটি পরে ওডিশা উপকূল দিয়ে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ওপর আছড়ে পড়তে পারে। ভারতের সূত্রগুলো বলছে, এর জেরে ২৫ মে সন্ধ্যা থেকে পশ্চিম বাংলার উপকূলবর্তী জেলাগুলোয় ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে হালকা থেকে মাঝারি এবং কোথাও ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আগামীকাল থেকেই আন্দামান এবং আশপাশে বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় ঘণ্টায় ৪৫-৫৫ কিলোমিটার ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে। কোনো কোনো জায়গায় হাওয়ার গতি ঘণ্টায় ৫০-৬০ কিলোমিটার বা সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটারও হতে পারে।

দিন দশেক আগে প্রথম এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আভাস দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল। এখন পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য প্রায় সব আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল বঙ্গোপসাগরে এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কথা পরিষ্কারভাবেই বলছে। সব মডেলই বলছে, ঘূর্ণিঝড়টি ২৫ মে মধ্যরাত থেকে ২৬ মে সন্ধ্যার মধ্যে স্থলভাগে প্রবেশ করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মডেল মনে করছে ঘূর্ণিঝড়টি ওড়িশার উপকূল দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করার সম্ভাবনা বেশি। সেটি ঘটলে আমরা এ-যাত্রায় রেহাই পেয়ে যেতে পারি। তবে বাকি সব মডেলই (আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি) বলছে ঘূর্ণিঝড়টি ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশের ওপর দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করবে। মানে আম্পানের লাইন ধরে আঘাত হানতে পারে।

আম্পানের ঘা এখনো শুকায়নি
ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত করার প্রায় ৩০ ঘণ্টা আগে উপকূলের নানা জেলায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। যেসব এলাকায় শেষ পর্যন্ত আম্পান আঘাত হানেনি, সেসব এলাকায়ও বাঁধ ভাঙার ঘটনা ঘটেছিল। এ থেকে বোঝা যায় দিন দিন বাঁধ মানুষের জন্য কেমন বোঝা হয়ে উঠছে। সংবাদমাধ্যম একনাগাড়ে জানিয়ে যাচ্ছে, সব বাঁধ ভালো করে বাঁধা হয়নি। অনেক জায়গায় এখনো বড় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে। লেখক নিজেও ঘুরে ঘুরে সরেজমিনে সেসব প্রত্যক্ষ করেছেন।

অঙ্কের হিসাবে ইয়াস এখন পর্যন্ত মাঝারি মাপের বেচারা টাইপ একটা ঘূর্ণিঝড়। ভারতের সূত্রগুলো যদিও বলছে খুব বড়জোর এর গতি হবে ৭০ কিলোমিটার। কিন্তু অন্যান্য মডেলগুলোর মতে স্থলভাগে প্রবেশের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এসব বাহাসে কান দিলে আখেরে আমাদের আফসোস করতে হতে পারে। মনে রাখতে হবে, একটা সাধারণ গোবেচারা টাইপ ঘূর্ণিঝড়ও জনপদ ফালা ফালা করে দিতে পারে, যদি সে জোয়ারের ভরা কাটালে আঘাত হানে। ২৫ মে রাত থেকেই পূর্ণিমা তিথি শুরু আর ২৬ মে ভরা পূর্ণিমা। প্রাকৃতিক নিয়মে এমনিতেই এ সময় জোয়ারের উচ্চতা ২ থেকে ৩ ফুট বেশি হবে। আর ইয়াসের আশকারা পেলে উপকূলে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানা বিচিত্র কিছু নয়। এমন হলে সেটা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বর্ণিত উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসেই বেড়িবাঁধের অপেক্ষাকৃত দুর্বল স্থানগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, লোনা পানিতে তলিয়ে যাবে জনপদ। বর্ষা নেমে গেলে মানুষকে বেড়িবাঁধে ঠাঁই নিতে হবে না হয়তো। চলে যেতে হবে অন্য কোথাও। করোনার কারণে অন্য জায়গায় কাজের সুযোগ এখন আর আগের মতো নেই।

এ রকমের একটা বিপর্যয় রোধ করার জন্য হাতে যে কদিন সময় আছে, সেটা কাজে লাগানো উচিত। স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এখনই খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধগুলো নিরীক্ষা করে, জরুরি মেরামতের পদক্ষেপ নিতে পারেন। যেহেতু এ দেশে এখন আর নিজে থেকে কেউ নড়ে না, লাঠি আর মুলা ছাড়া কেউ নিজ গরজে কিছুই করে না, তাই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকেই হয়তো এগিয়ে আসতে হবে। বলতে হবে পূর্ণিমা রাতে বাঁধ যেন পালিয়ে না যায়।

সাইক্লোন শেল্টার ব্যবস্থাপনা
আতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে উপমহাদেশ যখন কুপোকাত আর তৃতীয় ঢেউয়ের আওয়াজ শুনছি প্রতিনিয়ত, তখনই আসছে ইয়াস। গাদাগাদি করে থাকার পরও গতবার সাইক্লোন শেল্টার থেকে কোভিড ছড়ায়নি। গবেষণালব্ধ বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্যপ্রমাণ না থাকলেও বলা যায় গত মে মাসে আম্পানের সময় গ্রামগঞ্জের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল না। এবার কি বুকে হাত দিয়ে সেটা কেউ বলতে পারবে? কাজেই সাইক্লোন শেল্টারে যথেষ্ট পরিমাণে সাবান-পানি আর মাস্ক রাখতে হবে, আর নিশ্চিত করতে হবে সেগুলোর ব্যবহার। সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকেরা এ বিষয়ে সচেতন আছেন। তবে কাজের সময় এগুলো যেন সবার নাগালে থাকে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক
nayeem 5508 @gmail. com