দুঃসময় পার করছে আমাদের গ্রহ

স্টিফেন হকিং
স্টিফেন হকিং

কেমব্রিজভিত্তিক একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হওয়ার সুবাদে আমি অতিমাত্রার সুবিধাসমৃদ্ধ একটি জমকালো জীবন কাটিয়েছি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেন্দ্রস্থল কেমব্রিজ আর দশটা নগর থেকে আলাদা একটি শহর। আমার বয়স ২০-এর কোঠা থেকে এই শহরের বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের মধ্যে আমি কাটাচ্ছি। তখনকার তুলনায় শহরটি এখন অনেক বেশি ছিমছাম হয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকা আন্তর্জাতিক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের একটি ছোট গ্রুপ আছে, যে গ্রুপের অনেকে নিজেদের সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানো মানুষ ভাবতে পছন্দ করেন। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকা এসব মানুষের সঙ্গে আমার কর্মজীবন কেটেছে। এর বাইরে কিছু বই লেখার সুবাদে অর্জিত তারকাখ্যাতি এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে জনবিচ্ছিন্ন হওয়া আমাকে এটি ভাবতে প্রলুব্ধ করেছে যে আমার সাফল্যের চূড়া অন্যদের চেয়ে উঁচু।

সম্প্রতি আমেরিকা এবং ব্রিটেনে সম্ভ্রান্ত শ্রেণিকে প্রত্যাখ্যানের যে ঘটনা দৃশ্যমান হলো, সেখানে নিশ্চিতভাবেই অন্য এলিটদের মতো আমিও নিজেকে আমজনতার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে মনে করেছি। ব্রিটিশ ভোটারদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া (ব্রেক্সিট) এবং আমেরিকান জনগণের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে নির্বাচিত করার সিদ্ধান্তকে আমরা যে চোখেই দেখি না কেন, এখন বিশ্লেষকদের মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, এ দুটি ঘটনা সেই সব মানুষের ক্রোধের ফল, যারা মনে করে তাদের নেতারা তাদের স্বার্থ দেখে না। সবাই মনে হয় একমত হবেন, এমন এক মুহূর্তে ঘটনা দুটি ঘটেছে যখন সবখানেই বিশেষজ্ঞ ও এলিট শ্রেণির উপদেশ-পরামর্শ জনগণ প্রত্যাখ্যান করা শুরু করেছে। আমি এই এলিটদের বাইরের কেউ নই। ব্রেক্সিট ভোটের আগে আমিও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলাম, ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া দেশটির বিজ্ঞান গবেষণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এটি ব্রিটেনকে পশ্চাদ্গামী করে ফেলবে। কিন্তু ভোটাররা রাজনৈতিক নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, শিল্পী, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী ও চিত্রতারকা-কারও কথাই আমলে নেননি।

এই দুই দেশের ভোটাররা যে বিষয়ে তাঁদের মত দিয়েছেন, সে বিষয়ে আমার মতো অভিজাত সম্প্রদায় কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটি এখন বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এখন কী করা উচিত? আমাদের পরামর্শ নিতে ব্যর্থ হয়ে নির্জলা জনতুষ্টিবাদের পক্ষে ভোটাররা যে রায় দিয়েছেন, আমরা কি তাঁদের সেই রায়কে প্রত্যাখ্যান করব? এ ক্ষেত্রে আমার কথা হলো, তাহলে আরও ভয়ানক ভুল হবে।

বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক পরিণতি এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ক্রমবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই ভোট কী প্রভাব ফেলবে, তা নিশ্চিতভাবে বোধগম্য। কারখানাগুলোর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ইতিমধ্যেই গতানুগতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে এবং কর্মসংস্থান কমিয়ে দিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মসংস্থানে ধস নামিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সংকটে ফেলে দিয়েছে।

বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যেই যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে উঠেছে, এসব প্রযুক্তি সেই বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে। ইন্টারনেট এবং আরও কিছু ক্ষেত্র খুব ছোট ছোট গ্রুপে থাকা লোকজনকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করার সুযোগ করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে চাকরির সুযোগ পাচ্ছে খুবই কমসংখ্যক মানুষ। এটি অবশ্যম্ভাবী যে এতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হলেও এটি সামাজিকভাবে ধ্বংসাত্মক পরিণতি আনছে।

আমাদের বুঝতে হবে, অর্থনৈতিক ভাঙনের ধারাবাহিকতায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, যেখানে আর্থিক খাত থেকে খুব কমসংখ্যক মানুষ বিপুল পরিমাণ পারিতোষিক নিয়ে যাচ্ছে এবং তাঁদের লোভের ঘুঁটি হিসেবে আমরা তাঁদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি। এমন অবস্থা আমাদের সংকোচনশীল নয়, বরং সম্প্রসারণশীল আর্থিক বৈষম্যের এমন এক দুনিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সাধারণ মানুষ মানসম্মত জীবনযাপন তো দূরের কথা, জীবন ধারণের জীবিকা অর্জনের পথ খুঁজে পাচ্ছে না। এ কারণে এ বিষয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে তারা নতুন কোনো পন্থা খুঁজছে এবং তাদের সেই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ট্রাম্প এবং ব্রেক্সিট কাণ্ডের অবতারণা হয়ে থাকতে পারে।

আরেকটি বিষয় হলো, বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপ্তির কারণে আর্থিক বৈষম্যের চেহারা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি ফুটে উঠছে। আমার কাছে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তি খুবই গ্রহণযোগ্য মাধ্যম। প্রযুক্তি না থাকলে আমার পক্ষে বিগত বহু বছর ধরে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু বুঝতে হবে, বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকার ধনিক শ্রেণির জীবনযাপন কেমন, তা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সামর্থ্য থাকা একজন গরিব মানুষ অত্যন্ত পীড়াদায়ক অনুভূতি নিয়ে দেখছে। সাব-সাহারান এলাকায় এখন যত মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায় না, সেখানে এখন তার চেয়ে বেশিসংখ্যক লোকের হাতে মোবাইল ফোন। তার মানে উত্তরোত্তর জনাকীর্ণ হতে থাকা আমাদের এই গ্রহে কিছুদিনের মধ্যেই এমন অবস্থা তৈরি হবে, যেখানে প্রায় কারও পক্ষে বৈষম্য থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব হবে না।

আমার কাছে এখন সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো মানব ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে আমাদের এই গ্রহে সম্মিলিতভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমাদের সামনে কয়েকটি ত্রাসোদ্দীপক চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে। সেগুলো হলো জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য উৎপাদন, জনসংখ্যার আধিক্য, নানা প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি, মহামারি রোগ, মহাসাগর দূষিত হয়ে ওঠা ইত্যাদি।

এগুলো আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমরা মানবসভ্যতার অগ্রগতির পথে ভয়াবহতম সময়ে আছি। যে গ্রহে আমরা বাস করি সেটি ধ্বংস করার প্রযুক্তি আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি, কিন্তু এই গ্রহ থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রযুক্তি এখনো আমরা বের করতে পারিনি। হয়তো কয়েক শ বছরের মধ্যে আমরা অন্য গ্রহে পাড়ি জমাতে পারব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের হাতে একটাই গ্রহ আছে এবং এ কারণে এই গ্রহ রক্ষার স্বার্থেই আমাদের মিলেমিশে কাজ করা দরকার। এটা করতে হলে দেশের মধ্যে কিংবা এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বিভাজনরেখা হিসেবে দেয়াল তুলতে নয়, বরং ভেঙে ফেলতে হবে। আমরা যদি সেটা করতেই চাই তাহলে বিশ্বনেতাদের স্বীকার করে নিতে হবে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। অল্প কয়েকজনের হাতে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে উঠছে তার সুষম বণ্টন হতে হবে।

(সদ্য প্রয়াত স্টিফেন হকিংয়ের এই প্রবন্ধটি ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় ছাপা হয়। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে প্রবন্ধটি ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে দেওয়া হলো।)

স্টিফেন হকিং: সদ্য প্রয়াত বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী