দুই খানের গল্প নয়, দুটি দেশের গল্প

সাহেবজাদা ইয়াকুব খান
সাহেবজাদা ইয়াকুব খান

সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ৯৫ বছর বয়সে মুখে প্রশস্ত হাসি নিয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। কিন্তু খুব কম মানুষই জানে, ওই হাসির আড়ালে কত দুঃখ লুকিয়ে আছে। তিনি প্রথমে সৈনিক ছিলেন, পরবর্তীকালে কূটনীতিকে পরিণত হন। সব সময় যুদ্ধের বিরোধী ছিলেন। কয়েক বছর আগে ইসলামাবাদের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত মার্কিন সালিভান পঞ্চ ভ্রাতার গল্প বলেছিলেন, যাঁরা ১৯৪২ সালে সবাই একসঙ্গে জাপানের আক্রমণে মারা গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সালিভানদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না, কারণ তাঁরা একত্রে মারা গিয়েছিলেন। এরপর কিছুক্ষণ থেমে তিনি বলেন, তবে তাঁরা ভাগ্যবান ছিলেন এই অর্থে যে তাঁরা সবাই এক সেনাবাহিনীতেই কাজ করেছেন এবং একই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
সাহেবজাদা ইয়াকুব খান কখনোই যুদ্ধের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করেননি, যে অভিজ্ঞতা তাঁকে আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ও তাঁর ভাই সাহেবজাদা ইউনুস খান একত্রে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছেন, উভয়ই জেনারেল সার্ভিস মেডেল পেয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে ইয়াকুব খান মিসর-লিবিয়া সীমান্তে জার্মান ও ইতালীয় সেনাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। ওই সময় কারাগারে বসে তিনি জার্মান ও ইতালীয় ভাষা শেখেন। যুদ্ধের পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় তাঁরা দুই ভাইও পৃথক হয়ে যান, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা রামপুরের রাজা ছিলেন। মেজর সাহেবজাদা ইয়াকুব খান পাকিস্তানে চলে যান, আর তাঁর বড় ভাই সাহেবজাদা ইউনুস খান ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তার এক বছরের মাথায় দেখা গেল, দুই ভাই কাশ্মীরের যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরের বিরুদ্ধে নিজের ব্যাটালিয়ন নিয়ে যুদ্ধ করছেন, একে অপরের দিকে গুলি ছুড়ছেন। মেজর ইউনুস খানের বন্দুকের গুলিতে ইয়াকুব খান আহতও হন। যখন বড় ভাই বুঝতে পারেন, তাঁর গুলিতে ছোট ভাই আহত হয়েছেন, তখন তিনি চেঁচিয়ে বলেন, ‘ছোট ভাই, মন খারাপ করিস না, সৈনিক হিসেবে আমরা স্রেফ নিজেদের দায়িত্ব পালন করছি।’ পরবর্তীকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল মানেকশ ও কর্নেল জাসবির সিং মেজর ইউনুসের প্রশংসা করে ইয়াকুবের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। দুই ভাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীতে কাজ করায় ১৯৬০ সালের আগ পর্যন্ত তাঁরা কখনোই একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি, সে বছর ইয়াকুব কলকাতার মেয়ে তুবা খলিলিকে বিয়ে করেন। ছোট ভাইয়ের বিয়েতে ইউনুস তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে ইয়াকুব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি আর্মার্ড ডিভিশনের নেতৃত্বে ছিলেন, কিন্তু তাঁর বড় ভাই কর্নেল ইউনুস তত দিনে ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিলেন।
সেই একই সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিন তারকা জেনারেল হন। তাঁকে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হিসেবে ঢাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তাঁকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি সামরিক জান্তাকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান না চালানোর পরামর্শ দেন। তিনি ইয়াহিয়াকে লিখিতভাবে জানান, শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া সংশ্লিষ্ট কমান্ডারের কথা না শুনলে সাহেবজাদা ইয়াকুব খান পদত্যাগ করেন। ফলে প্রাথমিকভাবে তিনি জান্তার চক্ষুশূলে পরিণত হলেও শেষমেশ তিনিই সঠিক প্রমাণিত হন। অন্তত তিনি কোনো অপরাধের অংশীদার হননি।
জুলফিকার আলী ভুট্টো জানতেন, সাহেবজাদা ১০টির বেশি ভাষা জানতেন, যার মধ্যে ছিল ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, পারসিক ও আরবি। জেনারেল জিয়াউল হক যখন ১৯৭৭ সালে ভুট্টোর সরকারকে উৎখাত করেন, তখন সাহেবজাদা পাকিস্তানের রুশ রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি আবারও সাহসের সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জিয়াউল হককে কোনো রাজনীতিককে ফাঁসিতে না ঝোলানোর পরামর্শ দেন, কিন্তু জিয়াউল হক তাঁর কথা না শুনে ভুট্টোকে ফাঁসি দেন। জেনারেল জিয়াউল হক সাহেবজাদা ইয়াকুবকে ১৯৮২ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। সে বছরই তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে নয়াদিল্লি যান, আর ৩৬ বছর পর দুই ভাইয়ের সাক্ষাৎ হয়। চোখে পানি নিয়ে তাঁরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন, কিন্তু ১৯৪৮ সালের ঘটনা নিয়ে তাঁরা কথা বলেননি।
পরবর্তী কয়েক বছর সাহেবজাদা ছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির হাস্যোজ্জ্বল মুখ, যদিও পররাষ্ট্রনীতির নাটাই ছিল জান্তার হাতে, যারা আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য বেসরকারি জঙ্গিবাহিনী গড়ে তুলেছিল। ১৯৮৬ সালে জেনারেল জিয়াউল হক ইয়াকুব খানকে কারগিল দখল করার পরিকল্পনা জানান, সেনাবাহিনীর কয়েকজন কমান্ডার ওই পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ইয়াকুব সঙ্গে সঙ্গে ওই পরিকল্পনা বাতিল করে দেন। সৌভাগ্যবশত জেনারেল জিয়াউল হক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একমত হলে ওই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। এর কয়েক বছর পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো তাঁর মন্ত্রিসভাকে জানান, সেনাবাহিনী কারগিলের পাহাড়ের কিছু কৌশলগত জায়গা দখল করতে চায়। যথারীতি সেবারও সাহেবজাদা খুব জোরের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন। বেনজিরকেও তিনি ‘না’ বলতে বাধ্য করেন। কিন্তু তৃতীয়বার সেনাবাহিনী সরকারকে না জানিয়েই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়, ফলে পাকিস্তানকে অনেক ভুগতে হয়েছিল।
সাহেবজাদা ইয়াকুব ছিলেন পাকিস্তানের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি যেমন জেনারেল জিয়াউলের সঙ্গে কাজ করেছেন, তেমনি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী যেমন বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফের সঙ্গেও কাজ করেছেন। কূটনীতিতে তিনি ছিলেন এক কিংবদন্তি। শেষ দিনগুলোতে তিনি নীরবে নওয়াজ শরিফের সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটানোর তাগিদ দিয়েছেন।
স্মৃতিকথা লিখতে বললে তিনি জবাব দিতেন, ‘আমি নিজের বেদনা ও অর্জনের কথা লিখে লোকের তামাশা হতে চাই না।’ তিনি বলেছিলেন, ‘নিজের কথা বলতে গেলে ভাইয়ের কথা না বললে হবে না, আর সে তো ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করেছে। সে তার কাজ করেছে, আমি আমারটা, আমরা একে অপরের দিকে গুলি ছুড়েছি।’ তাই তিনি এসব লিখতে পারবেন না।
১৯২০ সালে রামপুরে জন্ম হয়েছিল তাঁর, আর মৃত্যু হলো ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি। তিনি সব সময়ই ভারতে অবস্থানরত নিজের ভাই ও বোনদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাইতেন। তিনি কখনোই যুদ্ধে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমি অবশ্যই বলব, এটা দুই ভাই বা খানদের গল্প নয়, এটা দুটি দেশের গল্প, যাদের প্রয়োজন শান্তি।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভিতে কাজ করেন।