দুই বছরে প্রেসিডেন্ট সিসির ব্যর্থতা

>মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির মেয়াদ দুই বছর পূর্ণ হলো। মিসরের প্রখ্যাত সাংবাদিক কামাল গাবালা সিসির সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে দুই পর্বের নিবন্ধ লিখেছেন; আজ দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব
মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি
মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি

আগের লেখায় আমি সিসির শাসনামলের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেছিলাম। যারা মনে করে, সিসি ক্ষমতায় আসায় মিসরীয়রা জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো কাটাচ্ছে, তাদের কথা বলেছিলাম। সিসি ক্ষমতায় আসার দুই বছর হলো। একই সঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতা থেকে হটানোরও তিন বছর হলো। আজকের লেখায় আমি তাদের কথাই তুলে ধরব, যারা মনে করে, সিসির পারফরম্যান্স মিসরের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায়।
সিসি ক্ষমতায় আসার পর যুব প্রচারণা কমিটির প্রধান হাজেম আবদেল আজিম গণমাধ্যম থেকে রাতারাতি উধাও হয়ে যান, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে যার আবার পুনরাবির্ভাব ঘটে। আগে তিনি প্রেসিডেন্ট সিসির সমর্থক থাকলেও এবার তিনি তাঁর বিরোধিতা শুরু করেন: ‘শাসক সিসির চেয়ে রক্ষক সিসি ভালো।’ তিনি ৭০টি টুইট করে নিজের অবস্থান পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি সিসির বড় বড় প্রকল্পের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, এগুলো নিয়ে অনেক আবেগ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু কথা হচ্ছে, মিসরের অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ।
আজিম একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। শুরুতে সিসিকে সমর্থন দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মোহাম্মদ মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মিসরে এক অসহিষ্ণু পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, শুরু হয়েছিল সহিংসতা। ফলে তখন মিসরকে রক্ষা করার জন্য একজন মানুষের দরকার ছিল, আর সিসি ছিলেন সেই মানুষ। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন, সিসি আর ‘সঠিক পথে’ নেই, তখনই তিনি সিসির ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেন। তিনি বলেন, সিসির ওপর থেকে তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ‘শাইমা আল সাবাগের মৃত্যু’, সুয়েজ খাল নিয়ে নতুন প্রকল্প ও সৌদি আরবের কাছে তিরান ও সানাফির দ্বীপ ছেড়ে দেওয়ার চুক্তি। এসব কারণে তাঁর মধ্যে সিসি–বিরোধিতা তীব্র হয়।
তিনি ভেবেছিলেন, সিসি তরুণদের জায়গা করে দেবেন, কিন্তু সেটা না করে সিসি তরুণদের নিপীড়ন করেছেন, তাদের স্বাধীনতার রাশ টেনে ধরেছেন। সিসি বড় প্রকল্পের ব্যবস্থাপক হতে পারেন, কিন্তু তিনি গণপ্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নন। এমনকি এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন আছে, যেগুলোর আবার সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হয়নি বলে তিনি সমালোচনা করেন। ওই সময় রাজনৈতিক কর্মী ও প্রকৌশলী মামদু হামজা সিসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় সমর্থন দিয়েছেন, কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে তিনি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। এমনকি তিনি আগাম নির্বাচনেরও দাবি জানিয়েছেন। নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট দেশকে দেউলিয়া বানিয়ে ফেলেছেন, তিনি আমাদের ভিক্ষুক বানিয়ে ফেলেছেন।’ হামজা বলেন, সিসি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নানাভাবেই তাঁকে ‘হতাশ করেছেন’, সে কারণে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য নির্বাচিত হবেন না।
সিসির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ হিসেবে হামজা বলেন, প্রথমত, সুয়েজ খালের খননের ব্যাপারটা তাঁর পছন্দ হয়নি। এ ছাড়া তিনি বিদেশি ঋণ ও কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, সিসি নির্মাণকাজকে অর্জন মনে করেন, যিনি দেশকে একটি ‘বড় নির্মাণ কোম্পানিতে পরিণত’ করেছেন। মিসরের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। আর সিসি এত বড় নির্মাণকাজ করলেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যথেষ্ট মনোযোগ দেননি। দেশের ভেতরে অর্থ লেনদেনে সততার ঘাটতি আছে, আর সিসি ক্রমেই পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে—এসব কারণে তিনি সিসির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
টিভি উপস্থাপক ইব্রাহিম এইসাই প্রথম সাংবাদিক, যিনি সিসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এরপর তিনি একসময় সিসির প্রতি সমর্থনের কথা জানান। স্যাটেলাইট টেলিভিশন ‘অনলাইন টিভি’তে তিনি যে ২৫-৩০টি অনুষ্ঠান করেছেন, তাতে তিনি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হামদিন ও সিসি সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রথম প্রার্থী বহুদিন সংগ্রাম করেছেন, যাঁর ইতিহাসও সম্মানজনক, আর দ্বিতীয় প্রার্থী হাজার বছরের জন্য একদিন সংগ্রাম করেছেন।’
কিন্তু সাংবাদিক ফাতমা নাওতকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলে এইসা সিসির ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। তিনি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা এমন এক দেশে থাকি, যার প্রেসিডেন্ট সব সময় বলে বেড়ান দেশে ধর্মীয় বিতর্কের পুনর্জাগরণ ঘটেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, মুরসির আমলে যত মানুষ ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ সিসির আমলে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আমরা মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন নেতাকে সরিয়েছি, কিন্তু তার জায়গা নিয়েছে এখন ২০ জন।
এইসা মনে করেন, সিসি যা বলেন তার সঙ্গে বাস্তবতার অমিল অনেক, আর এই বৈপরীত্য হচ্ছে ব্যর্থতা এবং এই দেশের শেষের শুরু। তিনি বলেন, সিসি একদিকে মানুষের প্রতি দয়া দেখাচ্ছেন, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন যেমন হচ্ছে, তেমনি সব মিসরীয় নাগরিকের মনে নানা শঙ্কা ও হতাশা ভর করেছে।
ওদিকে স্বাধীন ওয়েবসাইট ‘আসওয়াত মাসরিয়া’ সিসির এই দুই বছরের সবচেয়ে গুরুতর কিছু সংকটের তালিকা করেছে, সেগুলো হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মরূদ্যান দুর্ঘটনা, রুশ বিমান দুর্ঘটনা, মিসরীয় বিমান দুর্ঘটনা, পুলিশের হাতে চিকিৎসকদের হেনস্তা, মিনায়ি গ্রামে খ্রিষ্টানদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, পুলিশের নির্যাতন প্রভৃতি। সিসি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুজন মন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। প্রথমজন হচ্ছেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইব্রাহিম (জানুয়ারি ২০১৩–মার্চ ২০১৫) ও মেজর জেনারেল মাগদি আবদেল গাফফার (মার্চ ২০১৫ থেকে এখন পর্যন্ত)।
কথা হচ্ছে, এই দুই বছরে পুলিশের নির্যাতনে বেসামরিক মানুষের হত্যার ঘটনা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল পুলিশের হাতে এক গাড়িচালকের হত্যার ঘটনা, যদিও সেই পুলিশ সার্জেন্টকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিসরের কারাগার, থানা ও জিজ্ঞাসাবাদের স্থানের বাজে পরিবেশের সমালোচনা করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশ আইন সংশোধনীর জন্য অপেক্ষা করছে, যে আইনের লক্ষ্য হচ্ছে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্কের রূপরেখা প্রণয়ন।
মেয়াদের প্রথম দিকে সিসি যেসব সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন, সেগুলো পরবর্তী বছরগুলোতে আরও তীব্র হতে পারে। ইথিওপিয়া এক জলাধার নির্মাণ করছে, সেটির ৭০ শতাংশ নির্মাণ হয়ে গেলে মিসরে পানির সংকট সৃষ্টি হতে পারে। আবার মিসরের নিরীক্ষা বিভাগের প্রধান হেশাম জেনিয়েনার অপসারণও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, দুর্নীতিবিষয়ক বেঠিক তথ্য প্রকাশের দায়ে তাঁকে সরানো হয়েছে।
অর্থাৎ সিসির পথ একেবারেই কণ্টকমুক্ত নয়; বরং সামনের দিনে তাঁকে অনেক সংকট মোকাবিলা করতে হবে।
কামাল গাবালা: মিসরের আল আহরাম পত্রিকা গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
প্রথম পর্ব : 
দুই বছরে প্রেসিডেন্ট সিসির সফলতা