দুই বছরে প্রেসিডেন্ট সিসির সফলতা

>
মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি
মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি

মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির মেয়াদ দুই বছর পূর্ণ হলো। মিসরের প্রখ্যাত সাংবাদিক কামাল গাবালা সিসির সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে দুই পর্বের নিবন্ধ লিখেছেন; আজ প্রথম পর্ব


এই নিবন্ধটি লেখার সময় এক মিসরীয় বিচারক ছয় ব্যক্তিকে অনুচরবৃত্তির কারণে কারাদণ্ড দেন, আর দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির আরও একবার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে মিসরের বিচার বিভাগ আরেকটি মামলার পর্যবেক্ষণ করছে, যার আসামি হচ্ছেন সাংবাদিকদের সিন্ডিকেটের প্রধান ইয়াহিয়া কালাশ, সাধারণ সম্পাদক জামাল আবদুল রহিম ও আন্ডার সেক্রেটারি খালিদ আল-বুলশি। এই তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তাঁরা অমর বদর ও মাহমুদ আল-সাক্কা নামের দুই সাংবাদিককে আশ্রয় দিয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে আদালত গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার জন্য দণ্ডাদেশ জারি করেছেন। এই দুই ব্যক্তিকে সেই সিন্ডিকেটের কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কথা হচ্ছে, মিসরীয় নাগরিকেরা গত দুই বছরে দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির কার্যক্রমের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। অনেকেই মনে করেন, গত দুই বছর ছিল মিসরের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিন। আবার অনেকেই মনে করেন, এই কালটা ছিল আধুনিক মিসরের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়। এই নিবন্ধে আমি মূলত ইতিবাচক দিকেই আলো ফেলব।
প্রথম দলটি মনে করে, প্রেসিডেন্ট সিসি মিসরকে মুসলিম ব্রাদারহুডের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন, যেটা আর কেউ পারেননি। অন্যদিকে দ্বিতীয় দলটি সিসির সমালোচনা করে এই কারণে যে এ সময়ে বিপুলসংখ্যক তরুণকে গ্রেপ্তার ও মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, একই সঙ্গে এ সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ও দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। ফলে মিসরীয় নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথম দলটির মতামত জানানোর জন্য আমি দুজন সাংবাদিকের মত উদ্ধৃত করব। কলামিস্ট মাকরাম মোহামেদ আহমেদ দৈনিক আল ওয়াতানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘একজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তির পক্ষে এটা অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে গত দুই বছরের কাজ সম্পাদনে প্রেসিডেন্ট সিসি অন্য যেকোনো সাবেক প্রেসিডেন্টকে ছাড়িয়ে গেছেন, তা সে ব্যক্তির যতই আপত্তি ও দ্বিধা থাকুক না কেন। তাঁর জমানার বিশেষ দিক হচ্ছে, তিনি এক বহুমুখী ও পূর্ণাঙ্গ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন।’
অন্যদিকে বাকরি নামের এক টিভি চ্যানেলের ‘ফ্যাক্টস অ্যান্ড সিক্রেটস’ অনুষ্ঠানে সাদা আল-বালাদ নামের এক সাংবাদিক বলেছেন, সিসি তো চাইলে নতুন বিমানের নামকরণ তাঁর নামানুসারে করতে পারতেন, কিন্তু সেটা না করে তিনি প্রয়াত নেতা গামাল আবদেল নাসেরের নামে এর নামকরণ করেছেন। এতে তিনি সিসির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলেছেন, ‘আমাদের নেতা একজন অনুগত মানুষ, যিনি সদ্বিশ্বাসের সঙ্গেই কাজ করেন।’
অন্যদিকে ইজিপশিয়ান সেন্টার ফর পাবলিক ওপিনিয়ন রিসার্চ ‘বারিসা’ সিসির দুই বছরের কার্যক্রম মূল্যায়ন করে বলেছে, দেশের ৯১ শতাংশ মানুষ তাঁর কাজে খুশি। আবার সেই জরিপের ৮১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, আগামীকাল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলে তাঁরা আবারও তাঁকেই ভোট দেবেন। আবার সিসির ক্ষমতায় আসার দুই বছর পূর্তিতে প্রেসিডেন্টের জনসংযোগ কার্যালয় প্রেসিডেন্টের দুই বছরের কার্যক্রমের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ রকম আরও অনেক সংস্থাই প্রেসিডেন্টের কার্যকলাপের ফিরিস্তি প্রকাশ করেছে।
প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির নেতৃত্বে গত দুই বছরে মিসর স্থিতিশীল হয়েছে, তার নিরাপত্তাও জোরদার হয়েছে। এই ক্রান্তিকাল খুব একটা দীর্ঘ হয়নি। মিসরীয়দের সচেতনতাও যেমন এর পেছনে ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি সিসির নেতৃত্বাধীন অনুগত সেনারাও ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা এমন এক দলকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছেন, যারা নিজেদের ইসলামি আখ্যা দিয়ে মিসরীয় সমাজকে ভাঙার চেষ্টা করেছে, যারা মিসরের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয় বদলে দিতে চেয়েছিল। ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর এই গোষ্ঠী বিভিন্ন চরমপন্থী শিবিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশে স্যাবোটাজ করার চেষ্টা করেছে, নাগরিক, পুলিশ ও সেনাসদস্যদের রক্ত ঝরানোর চেষ্টা করেছে। তবে মিসরীয় নাগরিকেরা সিনাইসহ দেশের বিভিন্ন অংশের সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে প্রমাণ করেছেন, তাঁদের যোগ্যতা আছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য আগে নিরাপত্তা প্রয়োজন।
গত দুই বছরে মিসরের সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন হয়েছে, তাদের তূণে নতুন নতুন অস্ত্র যুক্ত হয়েছে। সেসব অস্ত্র নির্দিষ্ট একটি দেশের কাছ থেকে কেনা হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানে, মিসর নিজের ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই নিরাপত্তার আয়োজন করেছে। ফলে মিসরীয় সেনাবাহিনী এখন বিশ্বের চতুর্দশ বৃহত্তম বাহিনী।
সেনারা যেমন দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, তেমনি দেশের অবকাঠামো খাতেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। ২০১১-১৪ সালে মিসরে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, সেনাবাহিনী সেটা দূর করেছে। আবার বিদ্যুতের বর্তমান সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গ্যাস, পারমাণবিক শক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক নতুন নতুন বড় প্রকল্প ও প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে এখন আর মিসরীয় নাগরিকদের জ্বালানির জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয় না, আর বন্ধ কলকারখানাগুলোও নতুন করে চালু করা হয়েছে।
এ ছাড়া চার হাজার কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, আর বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও চলছে। প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুত বহুমুখী গৃহায়ণ কর্মসূচি চালু হওয়ায় এ খাতেও ব্যাপক সাড়া পড়েছে। আসমারাত প্রকল্পের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বস্তিবাসীকে দুর্বিষহ জীবন থেকে বের করে নাগরিক জীবনে নিয়ে এসেছেন, যাতে তারা উন্নয়ন ও প্রগতিতে ভূমিকা পালন করতে পারে। একই সঙ্গে মিসরীয়রা এখন ডজন খানেক পানি পরিশ্রুতকরণ প্রকল্প ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নির্মাণে উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন, যেসব সেবা গ্রামাঞ্চলেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে সিনাই অঞ্চলেও পানির লাইন দেওয়া হবে। আর সুয়েজ খালের নিচ দিয়ে তিনটি সুড়ঙ্গ নির্মাণ করা হচ্ছে, যাতে সিনাইকে সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করা যায়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, একজন বোধসম্পন্ন মানুষ এটা স্বীকার করবেন যে সিসি প্রশাসন মিসরকে এক অস্থিরতা ও গোলযোগ থেকে বের করে এনেছে, যে কারণে মধ্যপ্রাচ্য ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। এমনকি তাঁর প্রশাসন মিসরের পররাষ্ট্র নীতিতেও বড় পরিবর্তন আনতে পেরেছে। ফলে মিসর এখন তার আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ও পক্ষপাতহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ না করে মিসর চীন, রাশিয়া, ইতালি, জার্মানি, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে পারে। প্রেসিডেন্ট সর্বশেষ টিভি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে “আমাদের” সম্পর্ক কৌশলগত, তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের স্বীকার করতে হবে যে অতীতের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা যেমন নেই, ৩০ বছর আগে যা প্রযোজ্য ছিল, সেটা এখন না-ও হতে পারে।’
আগামীকাল পড়ুন: দুই বছরে প্রেসিডেন্ট সিসির ব্যর্থতা
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কামাল গাবালা: মিসরের আল আহরাম পত্রিকা গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।