দুপুরে নয়, বাজেট পেশ হোক সকালে

আগামী মাসেই জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। এ বছরের জুন মাসের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আনুষ্ঠানিকভাবে এটি পেশ করবেন।

প্রচলিত প্রথা অনুসারে বাজেট সাধারণত দুপুরের পর (বেলা আড়াইটা বা তিনটা) উপস্থাপন করা হয়। বাজেট পেশ করার এই প্রথা মূলত ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা। ভারতেও বহু বছর এই প্রথা চালু ছিল, পাকিস্তানে এখনো আছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্যরা রেডিওর মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতের বাজেট শুনতেন বলে বিলেতের সকালের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে ভারতে বিকেলে বাজেট পেশ করা হতো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে গেলেও অযৌক্তিক বহু ঔপনিবেশিক নিয়ম, প্রথা ও রীতি উপমহাদেশে বহাল থেকে যায়, আজও আছে। তবে ১৯৯৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি এ প্রথা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী ২০০১ সালে অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা প্রথম বিকেল ৫টার বদলে বেলা ১১টায় ভারতের লোকসভায় বাজেট পেশ করেন। এরপর থেকে এই সময়ই বহাল আছে।

সপ্তাহের শেষ দিন দুপুরের পর বা বিকেলে বাজেট পেশের পক্ষে একটা বড় যুক্তি ছিল এ রকম যে করসংক্রান্ত প্রস্তাব কিংবা ঘোষণাগুলো নিয়ে ব্যবসায়ীরা যেন কোনো ধরনের বিশেষ সুযোগ নিতে বা কারসাজি করতে না পারেন। কারণ, করসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো প্রকাশ হতে হতে ব্যাংকের লেনদেন এবং বন্দরে শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে কেউ বাড়তি ফায়দা নিতে পারে না।

এই যুক্তি এখন দুর্বল হয়ে গেছে। ক্রমাগত সংস্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের করকাঠামো এখন অনেক স্বচ্ছ ও সহজ হয়েছে। যেমন ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে আমদানি শুল্কের ১৫টি ধাপ ছিল, যেখানে সর্বোচ্চ শুল্কহার ছিল ৩০০ শতাংশ। আর এখন আছে ছয়টি ধাপ, যেখানে সর্বোচ্চ শুল্কহার ২৫ শতাংশ। বাণিজ্য উদারীকরণের ফলে প্রচুর পণ্যের ওপর এখন আর শুল্ক প্রযোজ্য নয়। তা ছাড়া বাজেট করবিষয়ক গোপনীয়তা সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এখানে কোনো ত্রুটি বা ঘাটতি থাকলে প্রশাসনিকভাবেই তা ঠিক করতে হবে। আবার বাজেটের কোনো ঘোষণার কারণে ওই দিনের মুদ্রাবাজার, শেয়ারবাজার বা পণ্যবাজারে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়লে তাকেও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখা যেতে পারে।

শুধু সাংবাদিকেরাই নন, গবেষক-বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা এতে যথেষ্ট সময় পাবেন বাজেট খুঁটিয়ে দেখার ও বোঝার জন্য। আবার সরকারের দিক থেকেও বিভিন্ন বিষয় সুস্পষ্টীকরণ বা ব্যাখ্যার জন্য হাতে সময় থাকবে বিকেল থেকে। এতে অনলাইন এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াও ভালোভাবে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে। ফলে, বাজেটটিকে অনেক বেশি স্বচ্ছ ও স্পষ্টভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরা যাবে

বর্তমানে বাজেটের দলিলপত্র ও অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার অনুলিপি হাতে পেয়ে তা ঘেঁটে বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন সংবাদ ও বিশ্লেষণ তৈরি করার জন্য মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে তাই প্রয়োজনীয় অনেক পদক্ষেপ সম্পর্কে ভালোভাবে তথ্য দেওয়া যায় না। ফলে, পরের দিন সকালে পত্রিকা হাতে নিয়ে পাঠক অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হন। দ্রুত সময়ে বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে গিয়ে কিছু ভুলচুকের শঙ্কা থেকে যায়। যদিও এখন অনলাইন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভুল ধরা পড়লে তাৎক্ষণিক সংশোধন করা যায় বা হালনাগাদ করা যায়। কিন্তু ছাপা পত্রিকার জন্য সে সুযোগ নেই। আর সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হওয়া বাজেটবিষয়ক প্রতিবেদনগুলোই ভবিষ্যতে ইতিহাসের উপাদান হয়।

সন্দেহ নেই, বাজেটকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে গত দেড় দশকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। প্রতিবছর স্বল্প সময়ে বাজেটের বিভিন্ন দিক প্রায় নির্ভুলভাবে তুলে ধরার চ্যালেঞ্জটি সাংবাদিকেরা সাফল্যের সঙ্গেই মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। লিখিত প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণের পাশাপাশি কার্টুন, উপাত্তচিত্র, লেখচিত্র, সারণি আর ইনফোগ্রাফিকসের বিস্তার বাজেটকে একটি আকর্ষণীয় বিষয়ে পরিণত করেছে। তবে কাজটি আরও ভালোভাবে এবং আরও গুছিয়ে করার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন, তা মিলতে পারে বাজেট যদি বেলা ১১টা বা সাড়ে ১১টায় জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়। দেশের অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামও (ইআরএফ) এ রকম একটি দাবি তুলেছে।

শুধু সাংবাদিকেরাই নন, গবেষক-বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা এতে যথেষ্ট সময় পাবেন বাজেট খুঁটিয়ে দেখার ও বোঝার জন্য। আবার সরকারের দিক থেকেও বিভিন্ন বিষয় সুস্পষ্টীকরণ কিংবা ব্যাখ্যার জন্য হাতে সময় থাকবে বিকেল থেকে। এতে অনলাইন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও ভালোভাবে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে। ফলে, বাজেটটিকে অনেক বেশি স্বচ্ছ ও স্পষ্টভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরা যাবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের বাজেট উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে কিছু গুণগত পরিবর্তন এসেছে। সংসদে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ একাধিক সরকারি ওয়েবসাইটে বাজেটের দলিলপত্র উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অর্থমন্ত্রী এখন পাওয়ার পয়েন্টে বাজেট উপস্থাপন করেন। এই ধারাবাহিকতায় সকালবেলা বাজেট উপস্থাপন করার মতো একটি বড় পদক্ষেপ নিতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে পবিত্র রমজান মাসের কারণে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট বেলা পৌনে একটায় পড়া শুরু করেছিলেন।

এবারের বাজেটটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ৫০তম জাতীয় বাজেট। বাজেট পেশের সময়টা বিকেল থেকে সকালে নিয়ে আসার এ রকম উপলক্ষ খুব কমই আসে। আশা করা যায়, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের স্পিকার পরিবর্তনের এ বিষয় ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবেন।

আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]