দুর্বল ব্যবস্থাপনায় নাজুক সরকারি খাদ্য মজুত

সরকার গণখাতে বণ্টন বা বিক্রির জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে খাদ্য মজুত করে। এর জন্য রয়েছে সাইলো, সেন্ট্রাল স্টোরেজ ডিপো (সিএসডি) এবং লোকাল স্টোরেজ ডিপো (এলএসডি)। জানা যায়, এগুলোর বর্তমান ধারণক্ষমতা ২১ লাখ টন। এ মজুত বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা সরকার উপলব্ধি করেছে। ব্যবস্থা নিচ্ছে ধারণক্ষমতা ২০২৫ সাল নাগাদ ৩০ লাখ টনে উন্নীত করার। চালের মজুত গড়ে তোলা হয় প্রধানত ফসলের মৌসুমে অভ্যন্তরীণভাবে ক্রয় করে। আর গম মজুত করতে হয় মূলত আমদানি করে। ক্ষেত্রবিশেষে চালও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তবে বড় ধরনের ফসলহানি না হলে চাল আমদানির প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়।

উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আমাদের চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তা খুবই কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সময়ে–সময়ে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ কার্যক্রম দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্য কমে যায়। যেমনটা ঘটে চলছে একটি বছর ধরে। এ রকমটা আগেও ঘটেছে। বাজারে চাল আছে, আছে মজুতদারের কাছে। তবে তারা ক্রমান্বয়ে দাম বাড়িয়েই চলছে। চাপ পড়ছে আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতার ওপর। সরকারি খাদ্যভান্ডার থেকে ওএমএস, ভিজিএফ, ভিজিডি, কাবিখার মতো কর্মসূচিতে ঢালাওভাবে চাল ছাড়তে পারলে বাজারনির্ভরতা কমত। বাজারের নিয়মেই হ্রাস টানা পড়ত মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতায়। কিন্তু এমনটি করার সুযোগ সরকারের হাতে নেই। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ৩১ মার্চ ২০২১ তারিখ পর্যন্ত সরকারের গুদামগুলোয় ৪ দশমিক ১২ লাখ টন চাল এবং শূন্য দশমিক ৭১ লাখ টন গম মজুত রয়েছে। ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকের ভাষ্যমতে, গত বছর এ সময়ে সরকারের মজুত ভান্ডার ছিল ১৪ লাখ টনের মতো। সুতরাং মজুত পরিস্থিতি যে সন্তোষজনক নয়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সরকারি এ মজুত থেকে বিধিবদ্ধ রেশনিংয়ের আওতায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও কারাগারে কর্মরতদের নিয়মিত দিতে হয়। ১০ লাখ রোহিঙ্গার রেশনের জন্য টাকাটা জাতিসংঘ দিলেও জোগানটা দিতে হয় আমাদের মজুত থেকে। সুতরাং সরকারি খাদ্যভান্ডারের ওপর বড় রকমের চাপ এমনিতেই আছে। অন্যদিকে সরকারের ক্রমসম্প্রসারমাণ সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের বেশ কয়েকটি ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখা, ওএমএস, ১০ টাকা কেজি দরে চালে খাদ্য মজুত থেকেই মেটানোর কথা। কিন্তু মজুত যখন তলানিতে, তখন এগুলো সেভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছে টাকা। বলা চলে, খাদ্য মজুত একরকম ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থায় নেমে এসেছে।

দেশে কিনতে বিফল হয়ে বিদেশ থেকে এনে মজুত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সে হিসাবে কিছু কেনাও হয়েছে। তবে মনে হচ্ছে, আগ্রাসী কোনো প্রচেষ্টা নেই। উল্লিখিত সে দৈনিকটির প্রতিবেদন অনুসারে আসন্ন বোরো মৌসুমে চাল কেনার ওপর ভরসা করছে সরকার। উল্লেখ্য, বোরো আমাদের সবচেয়ে বড় ফসল। ৩ কোটি ৬০ লাখ টন চাল উৎপাদনের বিপরীতে বোরো থেকেই পাওয়া যায় প্রায় ২ কোটি টন। এ বছর ৭টি হাওর–অধ্যুষিত জেলায় ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। অনুমান করা হয়, এখান থেকে আসবে দেশের মোট উৎপাদনের শতকরা ২০ ভাগ অর্থাৎ ৪০ লাখ টন।

তবে এ হাওরের ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থাটা কত নাজুক, তা অনেকেই জানেন। একটি আগাম বন্যায় তলিয়ে দিতে পারে সবটাই। নিকট অতীতেও এমনটা হয়েছে। সে রকম হলে প্রভাব পড়বে গোটা বাজারে। আশা করছি তেমন হবে না। পরপর গত কয়েকটি বোরো ফসল সফলভাবে তুলে আনা গেছে। তবে তা এলেও তো সরকার বাস্তবমুখী কার্যক্রম না নিলে তাদের ভান্ডারে আসবে না। দরিদ্র কৃষকের লাভ নিংড়ে খাবে মজুতদার আর ফড়িয়া মহাজন। অন্যদিকে বাজারে চালের দাম বাড়ানোর চক্রটি বসে থাকবে না হাত গুটিয়ে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার সফল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হলো পর্যাপ্ত সরকারি মজুত এবং সে মজুত থেকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অব্যাহত বিতরণ।

দেখতে হয় গত মৌসুমে মজুত কার্যক্রম সফল হয়নি কেন? খাদ্যমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রী এবং সচিবকে নিয়ে রয়েছে ফুড প্ল্যানিং ও মনিটরিং ইউনিট (এফপিএমইউ)। তাঁরা খাদ্য সংগ্রহের পরিমাণ, প্রক্রিয়া ও দাম অনুমোদন দেন। কৃষি মন্ত্রণালয় সূচনাতে নির্ধারণ করে উৎপাদন ব্যয়। এর সঙ্গে মুনাফা যুক্ত করে এফপিএমইউ ধান ও চালের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করে। কিন্তু গত বছর সে সংগ্রহমূল্যের কিছুটা ওপরে ছিল বাজারমূল্য। সরকারের তালিকাভুক্ত সরবরাহকারীদের অনেকেই নির্ধারিত দামে চাল সরবরাহ করেনি। তারা দাম কিছুটা বৃদ্ধির দাবি করেছিল। সেটা যৌক্তিক মনে করা হয়নি। ফলে অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা মজুতে রাখতে পারেনি তেমন কোনো অবদান।

বিদেশ থেকে আমদানি ব্যবস্থাও পরিমাণ ও সময়সীমার আলোকে সন্তোষজনক বলা যাবে না। এফপিএমইউর একটি অবস্থান কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে একটি উৎসাহজনক মূল্য দেওয়া উচিত। কিন্তু যেটা দেওয়া হলো, সেটা বাজারদরেরও কম। তাহলে তারা কিংবা সরবরাহকারীরা কেন সরকারি খাদ্যগুদামে চাল দেবে! এ বাস্তবতাটুকু বিবেচনায় না নিলে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্য সংগ্রহ অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আমরা ভারত থেকে বহু কিছু শিখি। কিন্তু তাদের খাদ্য মজুত ও বিতরণ প্রক্রিয়াগুলো এখনো কিছুমাত্র অনুসরণ করছি না। তারা শতকরা প্রায় ৩০ শতাংশ লোককে ২ টাকা কেজিতে মাসের চাহিদা অনুসারে চাল বা গম সরবরাহ করছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। এ কার্যক্রমে ভারত সরকারের পাশাপাশি রাজ্য সরকারগুলো সংশ্লিষ্ট রয়েছে। ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যানুসারে ভারতের সরকারি খাদ্য মজুত ক্ষমতা ৮ কোটি ৭৭ লাখ টন। এর মাঝে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের গুদাম ও সাইলো রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এতদ্‌বিষয়ক এজেন্সি ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়া। তারা নিজস্ব গুদামের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতকে উৎসাহ দিয়ে ৮-১০ বছরের জন্য ভাড়া নেওয়ার চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা করে। জমি কেনা ও গুদাম নির্মাণ নির্দিষ্ট উদ্যোক্তার কাজ। এভাবে ধারণক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে চলছে।

গুদামগুলোতে সময়মতো শস্য কেনা এবং নিয়মিত তা থেকে বণ্টনের জন্য বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে সে দেশটিতে। এতদ্‌বিষয়ে আমাদের নেটওয়ার্কও নেহাত ছোট নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সিভিল সাপ্লাই নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলা সরকার গড়ে তোলে। সেটা আমাদের আজকের খাদ্য অধিদপ্তরের পূর্বসূরি প্রতিষ্ঠান। তবে তারা নীতিনির্ধারণ করে না। যাঁরা নীতিনির্ধারণ করেন, তাঁরা দেশে উৎপাদন মোটামুটি সন্তোষজনক হওয়া সত্ত্বেও কেন বিদেশ থেকে কিনতে হবে, এর গভীরে যান না।

খাদ্যনিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে সরকার সচেতন রয়েছে। তবে সংকটের সময়ে অনেকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। এ অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে বিভিন্ন ধরনের উৎসাহ দেওয়ার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। তবে ভালো ফসল ফলার পরও সরকারের গুদামে মজুদের জন্য বিদেশ থেকে খাদ্য কেনার যুক্তি যথেষ্ট দুর্বল। এখন সামনে যে সুযোগটা আসছে, তাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন বাস্তবমুখী তৎপরতা। প্রকৃতি বৈরী না হলে ভালো ফসল ফলবে বলে অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। আমরা চাই, সে ফসল ফলানো কৃষক থাকুন হাসিমুখে। পাশাপাশি তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের একটি ছোট অংশ দিয়ে গড়ে উঠুক নিরাপদ সরকারি মজুত। সে মজুত কাজ করবে চালের দামকে স্থিতিশীল রাখতে।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

[email protected]