দূর হোক পেনশনজীবীর দুর্ভোগ

অলংকরণ : মাসুক হেলাল

কয়েক বছর আগে পর্যন্ত শতভাগ পেনশন সমর্পণ করার সুযোগ ছিল। দেওয়া হতো প্রতি টাকার বিপরীতে এক শ টাকা। অবসরে গিয়েও সাংসারিক দায়দায়িত্ব শেষ হয় না অনেকের। কেউবা নিজের বা পরিবারের নিকটজনের অসুস্থতার জন্য খরচ করে ফেলেন মোটা অঙ্কের টাকা। তাই নগদ টাকাটার দিকেই ছিল ঝোঁক। আরও উল্লেখ্য, সে সময় পেনশন সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে আকর্ষণীয় মুনাফা দেওয়া হতো। আয়কর কাটা হতো অতি সামান্য। তাই সংগতভাবে অনেকে ধারণা করেছিলেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দিয়েই প্রাপ্য পেনশন সমর্পণের ক্ষতিটা পুষিয়ে যাবে।

কিন্তু সবকিছু হয়ে গেল গোলমেলে। কমল সঞ্চয়পত্রের মুনাফা। আবার তার ওপর চাপল উঁচু হারের আয়কর। অন্যদিকে ২০০৯ ও ২০১৫ সালের দুটো বেতন স্কেল আগের স্কেলগুলোর তুলনায় অনেক স্ফীত বেতন-ভাতার সুযোগ রাখে। এ বেতন বৃদ্ধিতে অবসর–সুবিধা আনন্দিত। বেতন কমিশনের সামনেও তাঁদের প্রতিনিধিরা চাকুরেদের বেতন আকর্ষণীয় হারে বৃদ্ধির সুপারিশ রেখেছিলেন। এসব বেতন বৃদ্ধি এবং বর্ধিত বেতনে যাঁরা অবসরে যাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে আগের অবসরজীবীদের আয়ের পার্থক্য দাঁড়ায় বড় রকম। তদুপরি শতভাগ পেনশন যাঁরা সমর্পণ করেছিলেন, তাঁরা আর্থিকভাবে হয়ে পড়েন পর্যুদস্ত। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, সমর্পণ করে তাঁরা পেয়েছিলেন ৮ বছর ৪ মাসের পেনশন। তখনকার বিধি অনুসারে তাঁরা এ বাবদ কোনো সুবিধা পাওয়ার কথা না থাকলেও গোটা বিষয়টি নিয়ে অবসরজীবীদের পুনঃ পুনঃ আবেদন-নিবেদনে সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়। সিদ্ধান্ত হয় পেনশন সমর্পণের ১৫ বছর পর আপনা থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবার পেনশন চালু হয়ে যাবে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সাহসী, সময়োচিত ও প্রশংসনীয়। এ সিদ্ধান্ত দরিদ্র শ্রেণির দিকে তলিয়ে যাওয়া কিছু লোকের সামাজিক নিরাপত্তার বলয়কে দৃঢ় করতে সহায়ক হয়েছে। যদিও তাঁরা পেনশন পাচ্ছেন অবসরকালীন বেতন স্কেলে।

একটি চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে এসব কল্যাণকর কাজে রাজনীতিবিদেরা সাধারণত তেমন বিঘ্ন সৃষ্টি করেন না। তবে দায়িত্ব নিয়ে নথি তৈরির কাজ যাঁদের হাতে, তাঁদের সবাইকে তেমন স্বতঃস্ফূর্ত দেখা যায় না। দুই বছর আগে এটা চালু করার সময়ে গেল গেল রব উঠেছিল। কিন্তু টাকার অঙ্কে বিষয়টিতে সরকারের সামর্থ্য ও চাকুরেদের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত ব্যয় বিবেচনায় সামান্য। জানা গেছে, বর্তমান অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ৭০ কোটি টাকার কিছু ওপরে। অর্থাৎ বছরে ৩০০ কোটির মতো ব্যয় হবে।

এ ক্ষেত্রে যদি ১৫ বছরের সময়সীমা শিথিল করে ১০ বছর করা হয়, তবে উপকারভোগীর সংখ্যা এবং ব্যয় কিছুটা বাড়বে। তবে খুব বড় কিছু হবে বলে মনে হয় না। ৫৭ বছরে অবসর নেওয়া ব্যক্তিরা ১৫ বছর পর ৭২ বছর বয়সী হবেন। সে পর্যন্ত কজনই বা বেঁচে থাকেন? তবে ২০১৫-এর বেতন স্কেল দেওয়ার সময় শতভাগ পেনশন সমর্পণ প্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই একটি পর্যায়ের পর পেনশন পুনর্জীবন খাতে ব্যয় আর বাড়বে না। বরং উপকারভোগীদের মৃত্যুর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে কমবে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, অবসরের পর শারীরিক শক্তির পাশাপাশি প্রভাব–প্রতিপত্তিও হ্রাস পায়। সরকারি কর্মচারীদের একটি ক্ষুদ্র অংশের অনৈতিক ও গণবিরোধী আচরণের ফলে গোটা চাকরিজীবীদের সম্পর্কে একটি বৈরী মনোভাব সমাজে লক্ষণীয়। অথচ হাজার হাজার চাকুরে কোনো দিন দুর্নীতি করেননি এবং অনেকের সে সুযোগও ছিল না। অবসরের পর দ্রুতই ফুরিয়ে যায় সম্পদ। বৃহত্তর পরিবারে উপেক্ষিত হন তাঁরা। অথচ সে সময় তাঁদের চিকিৎসা ব্যয় বাড়তে থাকে। এর সবকিছুর বিহিত সরকার করতে পারবে না। তবে এ ক্ষুদ্র পরিমাণ পেনশনটুকু পুনর্বহাল হলে অনেকের চোখেই আনন্দাশ্রু আসবে।

এখানে উল্লেখ করতে হয়, ২০১৫ সালে বেতন কমিশন রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্য গঠিত সচিব কমিটি আগে অবসরে যাওয়া চাকুরেদের সমস্যাটি তেমন একটা আমলে নেয়নি। তখন যাঁরা কর্মরত বা অবসরে যাচ্ছেন, মূলত তাঁরাই সে কমিটির রিপোর্টে সুফলভোগী। সে সময়েই অবসরে যাওয়াকালীন ছুটির বেতন এক বছরের পরিবর্তে দুই বছর করা হয়। পেনশন মূল বেতনের ৮০ থেকে ৯০-এ হয় উন্নীত। আবার বাধ্যকরী সমর্পণযোগ্য অর্ধেক পেনশনের প্রতি টাকার বিপরীতে ২০০ টাকার স্থলে ২২০ টাকা করে দেওয়া হয়। সবই ভালো উদ্যোগ। তবে এর আগে অবসরে যাওয়া চাকুরেরা পেলেন না কিছুই। বলা হয় বিধিতে নেই। বিধিতে ওপরের সুবিধাদিও ছিল না। সংশোধন করেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তেমন কিছু করার সুযোগ তাঁরা কাজে লাগাননি। যা-ই হোক অবসরজীবীদের সুবিধাদির জন্য চাকুরেদের দুয়ারেই যেতে হবে। আমরা আশা করব পূর্ণ সমর্পিত পেনশন ১০ বছর অবসরভোগের পর স্বয়ংক্রিয় পুনর্বহালের জন্য একটি উদ্যোগ তাঁরা দ্রুত নেবেন।

এরপর আলোচনায় আসে যাঁরা পেনশন পাচ্ছেন, তাঁরা কত পান। অবসর নেওয়ার সময়ে যে স্কেলে তিনি কর্মরত ছিলেন, তাকে ভিত্তি ধরে পেনশন নির্ধারণই বরাবরের নিয়ম। এখনো ব্যত্যয় হচ্ছে না। ধার্যকৃত পেনশন প্রতিবছর অনুল্লেখযোগ্য হারে কিছুটা বাড়ে। নতুন বেতন স্কেল দেওয়া হলে পেনশনধারীদের জন্য সে স্কেলের সুবিধাদির কোনো ধার না ধরেই থোকে কিছু টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে ২০০৯ সালের বেতন স্কেল দেওয়ার আগে যাঁরা অবসরে গেছেন, তাঁদের পেনশনের সঙ্গে হালে একই পদ থেকে অবসরপ্রাপ্তদের বৈষম্য হয়ে গেছে বড় রকম। ২৫ বছর আগে অবসরে যাওয়া একজন সরকারি কলেজশিক্ষকের পেনশন হালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যাঁরা অবসরে যাচ্ছেন, তাঁদের চেয়ে ক্ষেত্রবিশেষে কম। এ ধরনের বৈষম্য দীর্ঘকালই বিরাজ করছে। কিন্তু বড় ধরনের বেতন বৃদ্ধির ফলে বৈষম্যটা ধারণ করেছে প্রকট আকার।

এ ধরনের এক নিবন্ধে আমি দেখিয়েছিলাম ৩০ বছর আগে অবসর নেওয়া অষ্টম গ্রেডের একজন কর্মকর্তার পেনশন একই গ্রেড থেকে হালে অবসর নেওয়া তাঁর পুত্রের পেনশনের চেয়ে শোচনীয় হারে কম। এখন যাঁরা চাকরিতে আছেন, তাঁরা চাকরির বেতন ও সুবিধাদি ভোগ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে যখন অবসরে যাবেন, এ পদ থেকে তা ১৫-২০ বছর বা তারও আগে যাঁরা অবসরে গেছেন, সবাই তো একই কাতারে পেনশন পাওয়ার দাবি রাখেন। এ নিয়ে ভারতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেলদের একটি মামলার বিষয়ে আমি আগের নিবন্ধে উল্লেখ করেছি। ভারত সরকার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করলেও নীতিগতভাবে বিষয়টি মেনে নিয়েছে। পাশাপাশি বেসামরিক চাকুরেদের জন্যও ক্রমান্বয়ে ‘ওয়ান ব্যাংক ওয়ান পেনশন’ নীতিটি কার্যকরের প্রচেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে ২০১৫ সালে সপ্তম বেতন কমিশন সুস্পষ্ট সুপারিশ করেছে। জানা যায়, কেন্দ্রীয় ও সর্বভারতীয় বেশ কিছু চাকুরের মধ্যে নিয়মটি কিছু ক্ষেত্রে চালু হয়েছে। এটা সত্য, বাংলাদেশ এ দাবি মেনে নিলে পেনশন খাতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাবে। তাই রাতারাতি এটা বাস্তবায়ন সম্ভব বা সমীচীন না-ও হতে পারে। এর আর্থিক সংশ্লেষ হিসাব-নিকাশ করে দেখতে হবে। নীতিগত দিক মেনে নিয়ে বাস্তবায়নও ধীরে ধীরে করা যায়। এ লক্ষ্য সামনে রেখে বাস্তবায়ন–প্রক্রিয়া, সরকারের সামর্থ্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে একটি কমিশন বা কমিটিও গঠন করা যায়।

আজ দেশের সমৃদ্ধির যে সুফল হালের চাকুরে ও সদ্য অবসরজীবীরা ভোগ করছেন, এর ভিত তিলে তিলে গড়তে অবদান রেখেছেন তাঁদের পূর্বসূরিরা। তাঁদের অনেকেই হতদরিদ্র অবস্থায় আছেন। সবাই বড় চাকরি করতেন না। পিয়ন, করণিক ইত্যাদি নিম্ন বেতনভোগীরাও পেনশন পান। সেটা কত কম একটু ভেবে দেখা দরকার। সামাজিক নিরাপত্তাবলয়কে জোরদারের প্রয়াসে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা সময়োচিত। বর্তমান অবস্থার ন্যায়ভিত্তিক অবসানের জন্য কর্মরত চাকুরেরা তৎপর হলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বড় বাধা হয়ে কখনো দাঁড়ান না।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

[email protected]