‘দেবদূতদের’ সঙ্গে প্রতারণা করছে ট্রুডোর কানাডা

জাস্টিন ট্রুডো
ছবি: রয়টার্স

২০১৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথিত ‘মুসলিম নিষেধাজ্ঞা’র পর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো টুইট করেছিলেন, ‘অত্যাচার, নির্যাতন, সন্ত্রাস ও যুদ্ধের কারণে আপনারা যাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, কানাডা তাঁদের জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবাইকে সাদরে স্বাগত জানাবে। বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি।’ ট্রুডোর ওই টুইটের হ্যাশট্যাগ ছিল ‘ওয়েলকামটুকানাডা’। এরপর থেকে চার বছর ধরে সারা বিশ্বের বহু মানুষ মনে করে আসছে, ট্রুডো শরণার্থীদের জন্য তাঁর দেশের দরজা খুলে রেখেছেন।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। নিয়মিতভাবে কানাডাকে শরণার্থীদের উদার আশ্রয়স্থল বলে প্রচার চালানো হলেও আসল সত্যিটা হলো, এ ভয়াবহ করোনা মহামারির মধ্যেও কানাডা গণহারে শরণার্থীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে।

কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সির (সিবিএসএ) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০২০ সালে ট্রুডোর সরকার শরণার্থী ভিসা আবেদন করা ১২ হাজার ১২২ জনকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। ২০১৫ সালের (সে বছর ক্ষমতায় ছিলেন রক্ষণশীল সরকারের প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার) পর এক বছরে এতসংখ্যক মানুষকে ফেরত পাঠানো হয়নি। ২০২১ সাল শেষ হওয়ার আগে আরও কয়েক হাজার লোককে দেশে ফেরত পাঠানোর কথা।

প্রত্যাবাসনের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা কানাডায় কোভিড-১৯ মহামারির ভয়ংকরতম দিনগুলোতে নিজেদের জীবন হুমকিতে ফেলে অতি জরুরি প্রয়োজনীয় সেবা দিতে সামনের সারির করোনাযোদ্ধা হিসেবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁদেরই একজন মোমাদু কোনাত। ২০১৬ সালে তাঁর দেশ আইভরি কোস্টে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ লাগার পর তিনি পালিয়ে কানাডা চলে এসেছিলেন এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন। ২০২০ সালে কানাডায় যখন কোভিড-১৯ মহামারি তুঙ্গে, সে সময় তিনি মন্ট্রিয়েলে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দারোয়ানের কাজ করেছেন। ওই সময়ে কেয়ার হোমগুলো মহামারির কারণে ভয়াবহ অবস্থা পার করছিল এবং তাদের দৈনন্দিন কাজের লোকের দারুণ অভাব চলছিল। কোনাত দারোয়ানগিরির পাশাপাশি কোভিড আক্রান্ত রোগীদের কক্ষ পরিচ্ছন্ন করার কাজ করতেন এবং সে সুবাদে নিজেও করোনায় আক্রান্ত হন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি আবার দ্রুত কাজে ফেরেন।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ সেবা দেওয়ার পরও তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে কানাডা সরকার।

দেশে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকিতে থাকা যেসব লোক ৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অফিসের সামনে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কোনাতও ছিলেন। সেখানে তিনি বলছিলেন, ‘এতগুলো বছর এ দেশে এত এত কষ্টকর কাজ করার পর, মহামারির মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জরুরি সেবা খাতের কাজ করেছি এবং ট্যাক্স দিয়েছি। এখন আমাকে বলা হচ্ছে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এটি অন্যায়। এটি অবিচার।’ তিনি বলেন, ‘মহামারির সময় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দৈনন্দিন কাজ করেছেন শরণার্থীরা। অভিবাসীরা। আমি তঁাদের একজন। আমি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ধোয়ামোছার কাজ করেছি। এমনকি দিন-রাত দুই শিফটে কাজ করেছি। আর এখন যদি আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটি আমার জন্য চরম কষ্টের বিষয় হবে।’

নিয়মিতভাবে কানাডাকে শরণার্থীদের উদার আশ্রয়স্থল বলে প্রচার চালানো হলেও আসল সত্যিটা হলো, এ ভয়াবহ করোনা মহামারির মধ্যেও কানাডা গণহারে শরণার্থীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে।

‘শরণার্থীদের আলিঙ্গন’ করার অতিপ্রচারের বিপরীতে আসলে যা হচ্ছে তার একটি ছোট্ট উদাহরণ হলো কোনাতের এ অবস্থা।

মহামারির শুরুতে কানাডার রাজনীতিকেরা অতি প্রয়োজনীয় খাতের কর্মীদের, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকদের প্রকাশ্যে উচ্ছ্বসিত প্রকাশ করেছেন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২০ সালের এপ্রিলে কুইবেক প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া লেগো করোনা মহামারির সামনের সারির জরুরি কর্মীদের (রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরাসহ) ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল’ (দেবদূত) বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং তাঁদের সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

এর কয়েক মাস পর, অর্থাৎ ওই বছরের ডিসেম্বরে তাঁর সরকার সুনির্দিষ্টভাবে মহামারিতে আশ্রয়প্রার্থীদের রাখা ভূমিকা ও অবদানকে স্বীকৃতি দেয় এবং তাঁদের সরাসরি স্থায়ী বসবাসের অনুমতি দেওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল প্রকল্প’ নামের একটি কার্যক্রম শুরু করে।

এ কার্যক্রমের মতো অটোয়ার নেতৃত্বে অন্যান্য প্রদেশেও কিছু কার্যক্রম শুরু হয়। ওপরে ওপরে এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছিল কানাডা কতটা শরণার্থীবান্ধব দেশ। কিন্তু বাস্তবতা হলো কানাডার নেতাদের ভণ্ডামির এটিও আরেকটি দিক।

এ তথাকথিত ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল’ প্রোগ্রামে শুধু সেই সব আশ্রয়প্রার্থীর নাম রাখা হয়েছে, যাঁরা কেবল রোগীর চিকিৎসায় সরাসরি সহায়তার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। প্রথমে জরুরি কাজে নিয়োজিত সবাইকে এ প্রকল্পের আওতায় আনা হবে বলে বলা হলেও পরে দেখা গেল অন্যান্য খাতের সামনের সারিতে যাঁরা কাজ (যেমন খাবার মোড়কজাত করা কিংবা কঠিন শীতের মধ্যে খাবার বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কাজ) করেছেন, তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কোনাতের মতো যাঁরা হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দারোয়ানের কাজ করেছেন বা রান্নাবান্না কিংবা ঝাড়পোঁছের কাজ করেছেন, তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে।

এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে ট্রুডো যেভাবে তাঁর দেশকে শরণার্থীবান্ধব হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, আসলে বিষয়টা মোটেও তা নয়। বোঝা যাচ্ছে, কানাডা সেই আগের দিনের শরণার্থী ইস্যুতে ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে খুব একটা বেরিয়ে আসতে পারেনি।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

স্টেফান ক্রিস্টোফ মন্ট্রিয়েলে বসবাসরত একজন সংগীতশিল্পী ও কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট