‘দেশ বানাইলাম হামরা আর সুবিধা নিবে খালি ঢাকার লোকেরা’

শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনে শুধু ঢাকাতে হাফ ভাড়ার ঘোষণা দেয় পরিবহনমালিকেরা
ছবি: প্রথম আলো

রাস্তায় পরিচিত বা অপরিচিত কোনো মুরব্বিকে দেখলেই সালাম দেওয়া যেমন এক সময় সামাজিক ঘটনা ছিল, গণপরিবহনে হাফ পাসও ছিল তেমনই। চিলমারী থেকে যখন রংপুর যেতাম, তখন বলাও লাগত না। বাসের সুপারভাইজার পুরো টাকা দিলে নিজে থেকে অর্ধেক টাকা ফেরত দিতেন। এটা বলার বিষয়ই ছিল না। এমনই ছিল ঘটনা।

আগে দেয়ালে স্লোগান লেখা থাকত—শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার। বামপন্থী ছাত্রসংগঠন তো লিখতই, অন্যরাও এটা লিখত। আমরা ছাত্র আন্দোলন করেছি আরও নানা বিষয় নিয়ে। বিনা মূল্যে খাতা-কলম, বেতন কমানো, পর্যাপ্ত হল নির্মাণ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবহন বাস, এমনকি স্বতন্ত্র পরীক্ষা হল নির্মাণও ছিল দাবিতে। এখন এই দাবিগুলোকে বিলাসী মনে হয়। আমাদের মজ্জায় ঢুকে গেছে, ঢালো কড়ি, নাও সনদ। শিক্ষার বেসরকারীকরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দাবিগুলো যেন অনৈতিক হয়ে গেছে।

আগে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে ও একবেলা টিউশনি করিয়ে বেশ চলত। এখন সারা দিন টিউশনি করেও চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিও এমন জায়গায় গেছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে খুব একটা তফাত নেই। এখন কেউ যদি হলের ক্যানটিনে ফাও খাওয়ার জন্য গুন্ডামি করে, আমরা কি তাকে খুব দায়ী করতে পারি? রাষ্ট্র তো দায়িত্ব নিচ্ছে না। তরুণদের আত্মহত্যার স্রোত কীভাবে ঠেকাব?

ফেসবুকে অভিনু কিবরিয়া ইসলাম নামের একজন লিখেছেন, ‘জার্মানিতে একটা স্টুডেন্ট আইডি থাকলে নিজেকে রাজা মনে হইত। বিশাল স্টেটে বাস-ট্রেনে বিনা টিকিটে ঘোরা যাইত। শুধু তা-ই না, উইকেন্ডে সঙ্গে একজন নিয়ে ঘোরা যাইত যার ভাড়া লাগত না। স্টেটের বাইরে গেলে হাফ ভাড়া। মন খারাপ লাগলেই ট্রেনে উঠে পড়তাম। যেকোনো একটা স্টেশনে নেমে ঘোরাঘুরি করে আবার চলে আসতাম। শুধু তা-ই না, এই আইডি থাকলে পুরা ইউরোপে মিউজিয়ামগুলাতে হয় ফ্রিতে ঢোকা যাইত, নাইলে ডিসকাউন্টে। শুধু মিউজিয়াম কেন, চিড়িয়াখানা থেকে শুরু করে মুভি থিয়েটার, লাইব্রেরি সব জায়গায় ডিসকাউন্ট। এমনকি ভার্সিটি-সংলগ্ন খাবার দোকানেও কম পয়সা নিত।’

নয়াদিল্লিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার পাস নিয়ে শিক্ষার্থীরা এক মাস বাসে চলাচল করতে পারে। কলকাতায় সরকারি বাসে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ফ্রি যাতায়াত করতে পারে। মুম্বাইয়ে লোকাল ট্রেনের প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের ভাড়া ৫০ শতাংশ। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ফ্রি। নেপালে আন্তনগর ও দূরপাল্লার বাসে ৪৫ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার শিক্ষার্থীদের ৩০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়। ফিলিপাইন সরকার সব ধরনের গণপরিবহনের ভাড়ায় ২০ শতাংশ ছাড়। মালয়েশিয়ায় সিটি সার্ভিসে শিক্ষার্থীদের ভাড়া ৫০ শতাংশ। খোদ পাকিস্তানের অনেক প্রদেশে এই হাফ ভাড়া আছে।

আমরা মাথাপিছু আয়ে এগিয়ে গেছি। শিক্ষা-চিকিৎসার মতো মৌলিক বিষয়গুলো একবিংশ শতাব্দীতে যেন সুদূরের ঘটনা। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানকে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন ‘আসাদের শার্ট’ নামে কোনো কবিতা এই দেশে লেখা হয়নি। আইয়ুবগেট আসাদগেট হয়নি। আসাদ-মতিউরদের ১১ দফায় শিক্ষাকে পণ্য না করা, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবির কথা ভুলে গেলাম এত তাড়াতাড়ি? উনসত্তরই তো মুক্তিযুদ্ধের রিহার্সাল।

বলা হলো হাফ পাস সকাল সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কার্যকর হবে। সান্ধ্য আইন যেন। ছুটির দিনগুলোয় এটা কার্যকর হবে না। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এত দিন যে দাবি ছিল নিঃশর্ত, সেটি এখন শর্তযুক্ত হলো। সবচেয়ে আপত্তিকর যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা হলো এই হাফ পাস ঢাকার বাইরে কার্যকর হবে না।

বাহাত্তরের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ‘গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষিবিপ্লব’ বিষয়ে ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে যে নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার কথা বলা হয়েছে, তা আবার ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না’ বলে আরও বৈষম্য বাড়ানো হবে?

২.
আন্তর্জাতিক বাজারে গত কয় দিনে তেলের দাম ব্যারেলে ১০ থেকে ১২ ডলার কমলেও দেশে ১৫ শতাংশ বাড়তিই থাকল। তারপর পরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হলো ২৭ শতাংশের বেশি। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হলো ছাত্র আন্দোলন। তারপর আন্দোলনের মুখে নয় দফার একটি দাবি শর্ত সাপেক্ষে হাফ পাস মেনে নেওয়া হলো। বলা হলো হাফ পাস সকাল সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কার্যকর হবে। সান্ধ্য আইন যেন। ছুটির দিনগুলোয় এটা কার্যকর হবে না। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এত দিন যে দাবি ছিল নিঃশর্ত, সেটি এখন শর্তযুক্ত হলো। সবচেয়ে আপত্তিকর যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা হলো এই হাফ পাস ঢাকার বাইরে কার্যকর হবে না।

৩.
‘সোনার বাঙলা শ্মশান কেন?’ শিরোনামে একটি পোস্টারের কথা সত্তরের নির্বাচনে আমরা দেখেছি। সেখানে দেখেছি, ভোগ্যপণ্যের বেলায় পাকিস্তানের পূর্ব অংশের জন্য এক, পশ্চিম অংশের জন্য আরেকটা। এ ঘটনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ফল আজকের বাংলাদেশ।

প্রতিবছরের খানাজরিপগুলোয় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সাতটি শহর বাদে সারা দেশ গরিবানায় বিপুল ব্যবধান থাকে। শুধু ওই সব শহরে জন্মের কারণেই এগুলোর নাগরিকেরা জমিদারি আমেজ ভোগ করে তুলনায়। আর দেশের বাকি জনগণ দারিদ্র্যের নরকে থাকে। এই বাংলাদেশ তো আমরা কেউ চাইনি।

চিলমারী বন্দরের একজন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান, যিনি শিলিগুড়ির পানিঘাটা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন এবং উপজেলার ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়কও ছিলেন। নিজামির মন্ত্রিত্বের আমলে যিনি সাঈদীর জনসভা ঠেকিয়েছিলেন। তিনি হাফ পাসের ঘটনা শুনে বলেন, ‘দেশ বানাইলাম হামরা আর সুবিধা নিবে খালি ঢাকার লোকেরা? ফাইজলামো?’

নাহিদ হাসান রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি। [email protected]