‘দেশের ভাবমূর্তি’র সংজ্ঞা কী?

আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনের বিদায়ী চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ৮ মার্চ বলেছেন, তিনি নিজের সঙ্গে আপস করেছেন। তাঁর কথায়, ‘যখন কোনো বিষয়ে মনে হয়েছে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে, তখন নিজের সঙ্গে নিজে আপস করে সে ক্ষেত্রে কখনো কখনো সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। কারণ, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির বিষয়টি আমার কাছে সবার আগে।’ দুর্নীতিবিরোধী বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মূল্যায়নে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪৬-এ। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার সময় অবস্থানটি ছিল ১৪৫ নম্বরে। ২০১৮ সালে তা আরও নেমে ঠেকেছিল ১৪৯-এ। দেশের ভাবমূর্তি তাহলে কি আদৌ রক্ষা পেয়েছে?

দেশের ভাবমূর্তির অজুহাতের আশ্রয় নেওয়ার কারণ কি আসলে এটাই যে সরকারের বড় বড় প্রকল্পের দুর্নীতিগুলোর দিকে তাঁদের তাকানোরও সাহস হয়নি? যিনি যখন সরকারের রোষানলে পড়েছেন, তখনই দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁর সম্পদের অনুসন্ধানে কোমর বেঁধে নেমেছে। ওই ব্যক্তিরা বিরোধী দলের রাজনীতিক হলে তো কথাই নেই। সরকারি দলেরও সম্রাট-পাপিয়া-জি কে শামীমের মতো সেসব লোকের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি, তাঁরা তখনই কমিশনের নজরে পড়েছেন, যখন দলের নেতা কিংবা প্রশাসন তাঁদের ওপর রুষ্ট হয়েছেন।

এর আগের দিন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের মন্তব্যেও দেশের ভাবমূর্তির কথা এসেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বছরখানেক ধরে তদন্তাধীন একটি মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে আটক মো. গোলাম সারোয়ার নামের এক ব্যক্তির জামিন আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানিতে তিনি এই মন্তব্য করেছেন। সরকারের আপিল খারিজ করে আটক ব্যক্তির জামিন বহাল রাখার সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় তিনি বলেছেন, দেশের ইমেজ (ভাবমূর্তি) সবার আগে। দেশের ভাবমূর্তির ব্যাখ্যা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যেভাবে নির্ধারণ করে দেবেন, সেটাই যে চূড়ান্ত, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই। সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধান সেই ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে এ ধরনের কোনো ব্যাখ্যা আমরা পাইনি।

অন্যদিকে সংবিধান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা অন্য কোনো আইনে দেশের ভাবমূর্তির কোনো সংজ্ঞা দেওয়া নেই। এমনকি, দণ্ডবিধিতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ ও রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধগুলোর বর্ণনায়ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির কোনো উল্লেখ নেই। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমি বা আমার মতো আরও দশজন যেটিকে ন্যায্য ও বৈধ সমালোচনা হিসেবে ভাবছি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনুযায়ী যা প্রকাশ করছি, সেটিকে অভিযোগকারী ব্যক্তি বা তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী মনে করলেও করতে পারেন। ব্যক্তিভেদে এর সংজ্ঞায়নে এই ফারাক তাই অবশ্যম্ভাবী।

দেশের ভাবমূর্তি কী কী কারণে ক্ষুণ্ন বা হানি হতে পারে, সেই ধারণা সাধারণভাবে অন্য আর দশটা দেশের চেয়ে আলাদা হওয়ার কথা নয়। অবশ্য দেশটি যদি উত্তর কোরিয়ার মতো একনায়কতন্ত্র বা চীনের মতো একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা অথবা মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলোর মতো হয়, তাহলে অন্য কথা। সরকারপ্রধান কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা এবং ব্যঙ্গ করা গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এগুলো যত কড়া, তীক্ষ্ণ ও তীব্র হয়, ততই দেশটির ইজ্জত বাড়ে। বলা হয়, সেখানকার গণতন্ত্র প্রাণবন্ত ও নাগরিক স্বাধীনতা অবাধ বা মুক্ত। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে সেটাই দেখা যায়। আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও কিছুদিন আগ পর্যন্ত তা-ই ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবশ্য উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থানে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও সেখানে গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে। নাগরিক স্বাধীনতার বিবেচনায় এখন দেশটি আংশিক মুক্ত (ফ্রিডম হাউসের ২০২১ সালের প্রতিবেদন)।

ফ্রিডম হাউসের মূল্যায়নে বাংলাদেশেও আংশিক মুক্ত এবং ইকোনমিস্ট–এর ভাষ্যমতে হাইব্রিড শাসনের দেশ। এই মূল্যায়নের কারণগুলো বহুল আলোচিত। রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার কতটা আছে, সেটাই এর পরিমাপক। এসব অধিকারের অংশ হচ্ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়া, বহুদলীয় ব্যবস্থা এবং জনগোষ্ঠীর সব অংশের অংশগ্রহণ, সরকার পরিচালনায় স্বচ্ছতা, দুর্নীতির মাত্রা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তা ও গবেষণার স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। গত এক দশকে নির্বাচনব্যবস্থার যে ধ্বংসসাধন হয়েছে, তার পরিণাম হচ্ছে ভোটারবিহীন মনোনয়ন বৈধকরণ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আত্মসমালোচনার জন্য সহকর্মী এক কমিশনারকে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন করেছেন, কমিশনকে তিনি আর কত নিচে নামাবেন। বাস্তবতা হচ্ছে, কমিশনকে নিচে নামানোরও আর জায়গা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিবেদনগুলোতে গত সংসদ নির্বাচনের যে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তাতে কি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়নি?

ফ্রিডম হাউস লিখেছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দল ও তাদের মিত্র হিসেবে ধরে নেওয়া সবাইকে এবং সমালোচক গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সদস্যদের অব্যাহতভাবে হয়রানির মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করেছে। দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের রাজনৈতিকীকরণের কারণে দুর্নীতি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে আছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণে দুর্বলতার কারণে নিরাপত্তাবাহিনী নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেও দায়মুক্তি ভোগ করছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার নির্যাতনবিরোধী কমিটির পর্যালোচনাতেও বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, হেফাজতে মৃত্যু উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধির কথা উঠে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে তারা প্রতিটি ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত পরিচালনার সুপারিশ করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা কি দেশের ভাবমূর্তির জন্য বিবেচ্য নয়?

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী যে সূচকটি স্বীকৃত, সেই রিপোর্টার্স স্য ফ্রঁতিয়ের (আরএসএফ) সর্বসাম্প্রতিক মূল্যায়নে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১। দক্ষিণ এশিয়ায় তা ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেরও নিচে। আরএসএফ তার মূল্যায়নে বলেছে, আওয়ামী লীগের গৃহীত কঠোরতর ব্যবস্থাগুলোর শীর্ষস্থানীয় শিকারদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশি সাংবাদিকেরা। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বের ঘটনা যেমন বেড়েছে, তেমনি মাঠপর্যায়ে রিপোর্টারদের ওপর রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা বেড়েছে। সাংবাদিকদের নির্বিচার গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং যখন-তখন ওয়েবসাইট বন্ধের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক আরেকটি সংগঠন আর্টিকেল নাইন্টিনের হিসাবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০২০ সালে বাংলাদেশে এ আইনের অধীনে দায়ের করা হয়েছে মোট ১৯৮টি মামলা, যার আসামি ৪৫৭ জন। এগুলোর মধ্যে ৪১টি মামলায় আসামি ৭৫ জন পেশাদার সাংবাদিক। গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার এই যে করুণ চিত্র, তাতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে, এমনটি নিশ্চয়ই কেউ দাবি করবেন না?

রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ, আইসিপিপিআরে বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষরদাতা দেশ। এই সনদের ১৯ অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগের বিষয়ে কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের কথা উল্লেখ করে যে দুটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে জানানো হয়েছে, সেখানেও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বলে কিছু নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা এবং জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় বিধিনিষেধ আরোপের যে অবকাশ রাখা হয়েছে, তা অনেকটাই সীমিত। ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং প্ল্যাটফর্মগুলোয় মতপ্রকাশের প্রশ্নেও জাতিসংঘ ফোরামে যে ঐকমত্য হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, এই স্বাধীনতা হবে অফলাইনের অনুরূপ। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক তৎকালীন স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার ডেভিড কে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, এই সনদের ১৯-এর ৩ উপ-অনুচ্ছেদে উসকানি ঠেকাতে আইনগত নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে ‘ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা’ কিংবা ‘রাষ্ট্রক্ষমতা নস্যাতের’ মতো বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তির আইনগত কোনো ভিত্তি নেই।

প্রথম আলোর গবেষণায় দেখা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাগুলোর ৮০ শতাংশই করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী অথবা পুলিশ। অভিযোগের ধরনও একই—কথিত ‘কটূক্তি’ কিংবা ‘বিকৃত ছবি ‘আদান-প্রদানের মাধ্যমে ‘মানহানি’ অথবা ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’। ভিন্নমত ও সমালোচনার প্রতি ক্ষমতাসীন দল ও সরকার যখন ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, তখন বহুল সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ‘দেশের ভাবমূর্তি’র যথেচ্ছ ধারণার স্বীকৃতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। আইনে যা নেই, তা বর্জনই কি ভালো নয়?

কামাল আহমেদ সাংবাদিক