দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ধূসর ইতিহাস ভুলতে চায় জার্মানি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে ৭০ বছর আগে, ১৯৪৫ সালের ৮ মে। ওই দিন অ্যাডলফ হিটলারের ফ্যাসিবাদী জার্মানির আত্মসমর্পণের খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী মিত্র শক্তিগুলোর রাজধানী শহর মস্কো, প্যারিস, লন্ডন ও নিউইয়র্কের রাস্তায় বিজয়ের আনন্দে লাখ লাখ মানুষের ঢল নেমেছিল। কিন্তু এই বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল বহু মানুষের স্বজন আর অনেক কিছু হারিয়ে যাওয়ার করুণ সব কাহিনি। সেই কাহিনিতে ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের অনেক ত্যাগ, তবে ইউরোপীয় ইতিহাসে তা তেমন সমুজ্জ্বল নয়।
তিনটি মহাদেশে পাঁচ বছর আট মাস ধরে চলা যে ভয়াবহ ও নৃশংস যুদ্ধ ছয় কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, যে যুদ্ধে ৬০ লাখ মানুষকে বন্দিশিবিরে প্রাণ দিতে হয়েছিল, ধ্বংস হয়েছিল বহু শহর-নগর-জনপদ, বিংশ শতাব্দীর সেই সভ্যতা সংহারকারী যুদ্ধ, ফ্যাসিবাদের উত্থান ও তা নিয়ে আলোচনা ইউরোপে এখনো বিদ্যমান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ঘিরে মিত্র বাহিনীর অন্যতম সহযোগী দেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষ হয়ে উপনিবেশ অবিভক্ত
ভারতকে জড়িয়ে দেওয়া এবং তাদের পক্ষে ২৫ লাখ ভারতীয় সেনা সংগ্রহ, যাঁদের মধ্যে বহু বাঙালি সেনা ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার নানা রণাঙ্গনে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং প্রাণদান করেছিলেন, তাঁদের সেই ত্যাগের ইতিহাস ইউরোপে খুব কমই আলোচিত হয়। একইভাবে যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় ওই যুদ্ধের কারণেই যে ভয়াবহ মন্বন্তর ঘটেছিল, যাতে ৩০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছিল, সেই ঘটনাও আজ যুদ্ধের ইতিহাসে বিস্মৃতপ্রায়। ভারতে সেই সময়কার সমরনায়ক ফিল্ড মার্শাল আর্চবাল্ড ওয়েভেল ও তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিওপ্যাল্ড অ্যামেরির প্রস্তাবে বাংলার মন্বন্তরে সাহায্য ও সহায়তার কথা বলা হলেও গ্রেট ব্রিটেনের যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী ও ভারত–বিদ্বেষী বলে পরিচিত উইনস্টন চার্চিল সেই প্রস্তাব আমলে নেননি। সঠিক সময়ে সেই সাহায্য এলে হয়তো অবিভক্ত বাংলার মন্বন্তরে এত মানুষের প্রাণহানি ঘটত না।
প্রতিবছর এপ্রিল মাস এলেই শুরু হয়ে যায় ইউরোপ মহাদেশজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নানা স্মরণসভা,বন্দিশিবির মুক্ত দিবস। ইউরোপজুড়ে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের সংবাদে উঠে আসে যুদ্ধের বিয়োগান্ত মর্মস্পর্শী নানা অজানা স্মৃতি আর ঘটনা।
ম্যাক্স আইসেনকে ১৫ বছর বয়সে পরিবারের সবার সঙ্গে ধৃত হয়ে নাৎসি বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত হাঙ্গেরি থেকে বন্দীবোঝাই ট্রেনযোগে পোল্যান্ডের আউৎসুইৎতজ বন্দিশিবিরে আসতে হয়েছিল। ট্রেন থেকে নামার পরই বন্দী বাছাইপর্বে তাঁর বাবা আর চাচাকে আলাদা করা হয়েছিল। যাওয়ার সময় তাঁর বাবা ম্যাক্সকে বলেছিলেন, ‘তুই বেঁচে থাকলে বিশ্ববাসীকে নাৎসি বাহিনী কর্তৃক আমাদের অসহনীয় বন্দিজীবনের কথা জানাবি,’ এরপর অসহায় বাবা পুরোনো এক বন্দীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমার পরিবারের সঙ্গে আবার কখন মিলনের সুযোগ ঘটবে?’ সেই বন্দী তখন নরকপুরীসম বন্দীদের হত্যার জন্য ব্যবহৃত গ্যাস চেম্বারের লম্বা চিমনির ধোঁয়ার দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, ‘ওই চিমনির ধোঁয়ার মাঝে তোমার পরিবারের মিলন ঘটবে।’
ম্যাক্স আইসেন এই কুখ্যাত আউৎসুইৎতজ বন্দিশিবিরে তাঁর ছোট বোন, দুই ভাই, বাবা–মা, চাচা-চাচিসহ দাদা-দাদিকে চিরতরের জন্য হারিয়ে ফেলেন; মে মাসে এই বন্দিশিবিরটি মুক্ত হলে মৃতপ্রায় অবস্থায় তিনি মুক্ত হন। আউৎসুইৎতজ বন্দিশিবিরে ৭০ বছর আগে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে নিঃস্ব ম্যাক্স আইসেন ৮৬ বছর বয়সে জীবনসায়াহ্নে বাবার কথামতো এই মর্মভেদী সাক্ষ্য দিয়েছেন গত মাসের ২১ এপ্রিল জার্মানির লুনেবুর্গে সদ্য শুরু হওয়া আউৎসুইৎতজ বন্দিশিবিরে কর্মরত হিসাবরক্ষক যুদ্ধাপরাধী ৯৩ বছর বয়সী অসকার গ্রোয়েনিংয়ের বিরুদ্ধে শুনানিতে।
এমন হাজার হাজার যুদ্ধবিজড়িত ঘটনা আজও শোনা যাবে ইউরোপের নানা দেশে ঘরে ঘরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই যুদ্ধের হোতা দেশ জার্মানি বিভক্ত হয়ে যায়, বিভক্ত হয়ে যায় সারা ইউরোপ পূর্ব আর পশ্চিমে।
যুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের ১৬টি দেশ চার বছর ধরে আমেরিকার মার্শাল উন্নয়ন পরিকল্পনার অধীন অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতায় প্রাথমিক সংকট কাটিয়ে উঠেছিল। অপর দিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্রের অনুসারী পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে উন্নয়ন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পূর্ব আর পশ্চিমের সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে ছিল শীতল স্নায়ুযুদ্ধ। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে শীতল স্নায়ুযুদ্ধের অনেকটাই অবসান ঘটে। আর ১৯৯০ সালে আবার ঐক্য ঘটে পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির পরাজয় দেশটিকে ইউরোপসহ বিশ্বজুড়ে অনেকটাই একঘরে করে দেয়। হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইউরোপজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল; ধ্বংস-নির্যাতন-হত্যা, লাখ লাখ বন্দীকে আটক করে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে হত্যার ইতিহাস পৃথিবীর সব নির্মমতাকে ম্লান করে দিয়েছিল। ১৫ বছরের শাসনামলে হিটলার নিজ দেশেও অন্য ধর্ম, বর্ণ ও অন্য রাজনৈতিক মতাবলম্বীর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল। অনেক রাজনীতিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানীসহ নানা পেশার মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোয় পালিয়ে হিটলারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে, সেই চেষ্টা দেশের ভেতরেও হয়েছিল, তবে নাৎসি জার্মানি তাদের মিথ্যা প্রচার-প্রোপাগান্ডায় সম্মোহিত বহু মানুষকেই তাদের অনুসারী করতে সমর্থ হয়েছিল।
বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির প্রথম চ্যান্সেলর কনরাড আডেনআওয়ার প্রতিবেশী ফ্রান্সের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে ১৯৬৩ সালে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। একই ধারাবাহিকতায় আরেক চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ড ১৯৭০ সালে আগের প্রতিবেশী পোল্যান্ড সফরে গিয়ে ওয়ারসোতে নিহত ইহুদিদের স্মৃতিস্তম্ভে হাঁটু গেড়ে বসে ফ্যাসিস্ট জার্মানির হত্যা-ধ্বংসযজ্ঞের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
৭০ বছর আগের ফ্যাসিবাদী জার্মান প্রজন্মের সঙ্গে আজকের জার্মান প্রজন্মকে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। তবু ৭০ বছর ধরেই সব মূলধারার দল–মতনির্বিশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অপরাধবোধ কাঁধে নিয়েই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন নীতি ও নিজেদের গণতান্ত্রিক ধারা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রেখেছে।
যে জার্মান জাতি বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানসহ নানা ক্ষেত্রে অপরিসীম অবদান রেখেছে; তথাপি বিংশ শতাব্দীতে দু-দুটি মহাযুদ্ধ করে তারা তাদের ললাটে কালিমা লেপন করেছে। তবে জার্মানির যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম ৭০ বছর ধরেই তাদের সেই ধূসর ইতিহাসের আত্মসংকট থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টায় রত আছে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।
[email protected]