ধর্ষণ ঠেকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার

১৭ বছরের কিশোর সাদাত রহমান আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। অনলাইনে হয়রানি বা সাইবার বুলিং ঠেকানোর অ্যাপ আবিষ্কারের জন্য সাদাতকে এ দুর্লভ সম্মানে ভূষিত করেছে নেদারল্যান্ডসের মানবাধিকার সংস্থা কিডসরাইট। আমার মনে হয়েছে, যে প্রযুক্তিগত অ্যাপ্লিকেশন সাদাত আবিষ্কার করেছে, অনুরূপ একটি অ্যাপ ধর্ষণ ঠেকাতেও ব্যবহার সম্ভব।

পৃথিবীর সব দেশেই ছেলেমেয়েরা আজকাল অনলাইনে হয়রানির শিকার হচ্ছে। বন্ধুত্বের নাম করে ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি বা ভিডিও প্রকাশ এখন প্রায় রোগের মতো। এ কারণে কোনো কোনো মেয়েকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে। অহেতুক হেনস্তার জন্য অথবা ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে মিথ্যা কথা বা গুজব ছড়ানোও এখন ছোঁয়াচে রোগের মতো। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বন্ধুত্ব, তারপর টাকা হাতানোর ঘটনাও অতি পরিচিত। এসবের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, যাঁদের ঘরে কম বয়সী ছেলেমেয়ে রয়েছে, তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন। সাদাত নড়াইলের ছেলে, সেখানেও অনলাইনে হয়রানি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, এ থেকেই বোঝা যায় সংকট কত গভীর ও বিস্তৃত।

সাদাত যে অ্যাপটি নির্মাণ করেছে, তার মাধ্যমে শিশু-কিশোরেরা স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। ‘নড়াইল ভলান্টিয়ারস’ নামে এ অনলাইন সংস্থার সঙ্গে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের যোগাযোগ রয়েছে। সাইবার বুলিংয়ের কোনো তথ্য তাদের কাছে আসামাত্রই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলে। সবচেয়ে বেশি বিপদ অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে, ইন্টারনেটে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করতে হয়, না জানার ফলে এদের অনেকেই যৌন হয়রানির শিকার হয়। তেমন দুর্ঘটনা এড়াতে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সাদাতের অ্যাপে তারও নানা ‘টিপস’ রয়েছে।

সাদাত এবং তার মতো বাংলাদেশের চৌকস ছেলেমেয়েদের কাছে আমার একটি অনুরোধ। এমন একটা অ্যাপ বানাও, যার মাধ্যমে ধর্ষণ ঠেকানো যাবে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর অনেক দেশেই ধর্ষণ ও সব ধরনের যৌন অপরাধ ঠেকানোর ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশেই বা কেন হবে না?

কথাটা বুঝিয়ে বলি। আমি যে অ্যাপের কথা বলছি, তা একটি ডেটা ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। সারা মাস-বছরজুড়ে যত যৌন হামলার ঘটনা ঘটে, তার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি অপরাধীর নামধাম এই ডেটা ব্যাংকে থাকবে। এই অ্যাপের মাধ্যমে যে কেউ যৌন হেনস্তাকারীদের নামধাম ডেটা ব্যাংকে পৌঁছে দেবে। তথ্য সঠিক হলে ডেটা ব্যাংক যত দ্রুত সম্ভব তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেবে। প্রতিটি ঘটনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে তথ্যও থাকবে।

বাংলাদেশে ধর্ষণ করে শাস্তি পায় এমন ঘটনা হাতে গোনা, অধিকাংশই পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। শাস্তি হয় না বটে, কিন্তু তাদের ‘ফুট প্রিন্ট’ উধাও হয়ে যায় না। যে কেউ এ অ্যাপের মাধ্যমে ডেটা ব্যাংকে সংরক্ষিত তথ্য অনুসন্ধানে সক্ষম হবে। এ অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের গা বাঁচাতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়। অনলাইন ‘ট্র্যাকিং’-এর মাধ্যমে ঠিকানা বদলালেও এদের খোঁজ-তল্লাশ সম্ভব। এ ডেটা ব্যাংক অর্থপূর্ণ করার জন্য সাদাত ও তার বন্ধুদের শুধু পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য চাই তাই নয়, এ জন্য চাই স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক গণসংযোগ ক্যাম্পেইন। চাই মিডিয়ার ব্যাপক সমর্থন।

একটা অ্যাপ বা ডেটা ব্যাংক রয়েছে মানেই যে অপরাধ বন্ধ হবে, তা বলি না। তবে যৌন হয়রানি করে ‘বেনামি’ থাকা যাবে না, জানলে হয়তো অপরাধীরা কিঞ্চিৎ হলেও সতর্ক হবে, অপরাধের আগে দ্বিতীয়বার ভাববে।

সাদাত ও তার বন্ধুরা এমন একটি অ্যাপের কথা ভাবতে পারে, যার মাধ্যমে যৌন হয়রানির সম্ভাব্য শিকার ছেলেমেয়েরা আগাম ‘বিপৎসংকেত’ পাঠাতে সক্ষম হবে। এ জন্য একটি ‘সাপোর্ট নেটওয়ার্ক’ বা প্রতিরক্ষাব্যূহ গঠনের প্রয়োজন পড়বে। অনেকটা ‘নড়াইল ভলান্টিয়ারস’-এর মতো। কোনো ছেলেমেয়ে বিপদের আশঙ্কা দেখামাত্রই হাতের নাগালে রাখা অ্যাপের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবকদের ‘রেড অ্যালার্ট’ পাঠাবে।

আমেরিকায় অনেক আগে থেকেই একাধিকবার ধর্ষণের জন্য অভিযুক্ত ও শাস্তিপ্রাপ্তদের তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ইন্টারনেটে এদের প্রত্যেকের নামধাম, এমনকি ছবি রাখারও ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তি যাতে আবার একই অপরাধ না করে, সে জন্য ‘যৌন অপরাধীরা’ নিজেদের শুধু তালিকাভুক্ত করতেই বাধ্য নয়, কখনো ঠিকানা বদলালে তা জানানোটাও তাদের জন্য বাধ্যতামূলক। কোনো কোনো জায়গায়, যেমন ফ্লোরিডা, চিহ্নিত যৌন অপরাধীদের জন্য রয়েছে আলাদা পরিচয়পত্র। সবচেয়ে কঠোর নিয়মবিধি রয়েছে শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধীদের ক্ষেত্রে। তাদের অপরাধ-ইতিহাস নথিভুক্ত করার পাশাপাশি হাতের ছাপ, এমনকি ডিএনএ স্যাম্পল সংরক্ষণেরও নিয়ম রয়েছে। এটি একটি ফেডারেল উদ্যোগ, প্রতিটি অঙ্গরাজ্য যাতে সে নিয়ম নেমে চলে, সে জন্য বিশেষ বাজেটও রয়েছে।

সবাই যে এমন সরকারি রেজিস্ট্রার তৈরির পক্ষে তা নয়। যারা যৌন অপরাধীদের তালিকাভুক্তির বিরোধী তাদের যুক্তি, একবার এ তালিকায় নাম উঠলে অপরাধী ব্যক্তির পক্ষে সমাজে পুনর্বাসিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হারায়, চাকরি জোটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে, এমনকি বাড়িভাড়া পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এদের যুক্তি, অপরাধ যত বড়ই হোক, নির্ধারিত শাস্তিভোগের পর তাদের পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় তাদের আবার অন্ধকার জগতে ঠেলে দেওয়া হবে। এ সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে, নির্ধারিত সময়ের পর নিরাপদ বলে বিবেচিত অপরাধীদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া।

সাদাতের দেখানো পথ ধরে বাংলাদেশের প্রযুক্তি-প্রখর ছেলেমেয়েরা আরও একটা কাজ করতে পারে। ডেটা ব্যাংক তৈরি হলে হয়তো অপরাধীদের তালিকা মিলবে। ভবিষ্যতে তারা যাতে এ–জাতীয় অপরাধে যুক্ত না হয়, তাতেও সাহায্য হবে। কিন্তু যারা আশু বিপদের সম্মুখীন, এ অ্যাপ অথবা ডেটা ব্যাংক তাদের কোনো উপকারে আসবে না। সাদাত ও তার বন্ধুরা এমন একটি অ্যাপের কথা ভাবতে পারে, যার মাধ্যমে যৌন হয়রানির সম্ভাব্য শিকার ছেলেমেয়েরা আগাম ‘বিপৎসংকেত’ পাঠাতে সক্ষম হবে। এ জন্য একটি ‘সাপোর্ট নেটওয়ার্ক’ বা প্রতিরক্ষাব্যূহ গঠনের প্রয়োজন পড়বে। অনেকটা ‘নড়াইল ভলান্টিয়ারস’-এর মতো। কোনো ছেলেমেয়ে বিপদের আশঙ্কা দেখামাত্রই হাতের নাগালে রাখা অ্যাপের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবকদের ‘রেড অ্যালার্ট’ পাঠাবে। এটি এলাকাভিত্তিক হতে পারে, ক্যাম্পাসভিত্তিক হতে পারে, অথবা প্রশাসনের সহায়তায় শহরভিত্তিক হতে পারে।

ধর্ষণসহ সব ধরনের যৌন হেনস্তা সবচেয়ে বেশি ঘটে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি চারজন ছাত্রীর একজন ছাত্রাবস্থায় যৌন হামলার শিকার। এ দুর্যোগ কমাতে সানফ্রান্সিসকো শহরে ছাত্রছাত্রীদের হাতে একটি অ্যাপ তুলে দেওয়া হয়েছে, যার সাহায্যে তারা যৌন হামলার আগে ও পরে অভিযোগ নথিবদ্ধ করার সুযোগ পায়। এ ব্যবস্থার একটি কার্যকর দিক এই যে তাৎক্ষণিক সংকেত পাঠানোর সুযোগ থাকায় হেনস্তার শিকার ছেলেমেয়েরা নিজেদের ‘একাকী ও অসহায়’ ভাবে না। তার চেয়েও বড় কথা, এমন একটি সংকেতব্যবস্থার কথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ায় কোনো আগ্রাসী পুরুষ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা সহপাঠী অথবা শিক্ষক, যৌন হামলার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। এ সতর্কীকরণ ব্যবস্থা যে কার্যকর, সানফ্রান্সিসকো থেকে তার তথ্য–প্রমাণ মিলেছে।

মানছি, আমি যেসব উদাহরণ দিচ্ছি তার কোনোটাই হয়তো ধর্ষণের মতো অপরাধ বন্ধ করতে পারবে না। বাংলাদেশে ধর্ষণের সমস্যা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। পুলিশ কিছু ক্ষেত্রে হয় নীরব, নয়তো অপরাধের সহচর। তাদের বজ্র আঁটুনি কিন্তু ফসকা গেরো। এ বজ্র আঁটুনি একটু মজবুত করার উপায় হতে পারে নামধাম উল্লেখ করে অপরাধীদের সামাজিক লজ্জায় ফেলা। সংঘটিত অপরাধের ব্যাপারে সচেতনতা যত বাড়বে, তার প্রতিকারে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণও তত বাড়বে।

এসবই হয়তো কষ্টকল্পনা। প্রযুক্তির মাধ্যমে যৌন হয়রানি বন্ধের সম্ভাব্য ভালো-মন্দ দিকও হয়তো বুঝিয়ে বলতে পারিনি। কিন্তু পুলিশের মুখের দিকে না তাকিয়ে একটা কিছু করা দরকার। নড়াইলের সাদাত ‘সাইবার বুলিং’ বন্ধের কথা ভেবেছে, ভালো একটা সমাধানও বের করেছে। ওর মতো অন্য চৌকস ছেলেমেয়েরা যদি যৌন হয়রানি ঠেকাতে প্রযুক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার খুঁজে বের করতে মাথা খাটায়, একটা না একটা পথ তারা ঠিকই খুঁজে পাবে, এ বিষয়ে আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে।


হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক