ধ্বংস ও সংস্কারের মাঝে মিসর

কিছুদিন আগের এক নিবন্ধে দেখিয়েছিলাম, কীভাবে দ্য ইকোনমিস্টসহ পশ্চিমা গণমাধ্যম মিসরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা বলছে, সিসির নেতৃত্বে মিসর ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে সিসির ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনায় অর্থ না দেওয়া। এর জবাবে মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও অবস্থান নিয়েছে।
মিসরের আইনের এক অধ্যাপক নুর ফারাহাত ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ও মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় দেশের মধ্যকার লড়াই সম্পর্কে বলেছেন, অর্থনীতিবিদ বা স্থানীয় পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট-এর প্রচারণার জবাব দিতে পারত, কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এটা করা উচিত হয়নি। তিনি মনে করেন, মিসর আনুষ্ঠানিক অবস্থান নেওয়ায় পরিস্থিতি আসলে আরও খারাপই হলো।
অন্যদিকে কায়রোর আমেরিকান ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোয়াতাজ আবদেল ফাত্তাহ্ বলেছেন, মিসরে কিছু ‘ভাসা-ভাসা উন্নয়ন’ হচ্ছে, যদিও এর ‘মৌলিক অবনমন’ ঘটছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা উন্নতি করব না বা বিপ্লবী পরিস্থিতিতে ফেরত যাব না, কারণ আমরা আবিষ্কার করেছি এসবের কার্যকারিতা নেই। আর সব মিসরীয় যদি জার্মানি, জাপান বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে চলে যান, তাহলে সেসব দেশের উন্নয়নও থেমে যাবে এবং তারা ভেঙে পড়বে।’ না, তিনি এখানেই থেমে থাকেননি, তিনি আরও বলেন, ‘মিসরীয়রা গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত হননি, তাঁরা শুধু ভাসা-ভাসা কিছু ব্যাপার থেকে উপকৃত হতে পারেন।’ মিসরে এখন যা ঘটছে তাকে তিনি আখ্যা দেন এভাবে, ‘পুরোনো বইয়ের মলাট পরিবর্তন।’
গণমাধ্যম–ব্যক্তিত্ব গামাল আল-গামাল ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট সিসিই প্রথম, যিনি মিসরকে ‘পোড়ো জমি’ বা ‘আধা রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে এক নিবন্ধে তিনি লেখেন, ইকোনমিস্ট-এর সেই সিরিজে যেভাবে মিসরের বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘অস্বীকৃতির সংস্কৃতি’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, সেটা তাঁর পছন্দ হয়েছে।
নতুন সুয়েজ খাল উদ্বোধনের এক বছরের মাথায় ইকোনমিস্ট-এ যে ধারাবাহিক নিবন্ধ ছাপা হয়, তার একটির শিরোনাম ছিল ‘অস্বীকৃতির সংস্কৃতি’। সেই বিখ্যাত নিবন্ধ ‘মিসরের ধ্বংস’-এর উপশিরোনাম ছিল এ রকম: ‘আবদেল ফাত্তাহ্ আল সিসির অযোগ্যতা ও নিপীড়ন পরবর্তী বিদ্রোহের আগুনে ধোঁয়া দিচ্ছে।’
‘অস্বীকৃতির সংস্কৃতি’ সিরিজের সঙ্গে সুইস কার্টুনিস্ট পিটার শ্র্যাঙ্কের যে ব্যঙ্গচিত্র বেরিয়েছে, সেটি আমার বিশেষ পছন্দ হয়েছে। এতে দেখা যায়, পিরামিডের সারির মাঝে একটি পিরামিড উল্টো হয়ে আছে, সঙ্গে আছে সেই স্ফিঙ্কস, যেখানে টাকা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ছবির নিচে অর্থনীতি শব্দটি লেখা রয়েছে। এর মাজেজা হলো, ওই উল্টো পিরামিডের জায়গায় যে গর্ত হয়েছে, সেটি কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না, তা যত টাকা ঋণই নেওয়া হোক না কেন। ‘অস্বীকৃতির সংস্কৃতি’-তে বলা হয়েছে, যে রাষ্ট্রটি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য এত টাকা খরচ করল, সে এখনো বিনিয়োগের গন্তব্যের দিক থেকে পৃথিবীতে ১৩১তম।
মিসরের সাংবাদিক হামিদ রিজক ‘তাঁরা কেন সিসিকে ঘৃণা করেন?’ শীর্ষক এক রচনায় সরকারকে অনুরোধ করেছেন, তারা যেন মিসরের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের জিজ্ঞাসা করে, সিসি ও তাঁর শাসন কেন ঘৃণিত হচ্ছে। তারা যেন খতিয়ে দেখে, কেন এমনটা হচ্ছে। আরেক প্রখ্যাত মিসরীয় সাংবাদিক আবদুল্লাহ্ আল-সিনাওয়ে লিখেছেন, ইকোনমিস্ট-এর লেখার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, মিসরের অর্থনৈতিক সংকট কিন্তু ঘনীভূত হচ্ছে। এর মধ্যে দেশটির সরকার আইএমএফের সঙ্গে ১২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এমনকি সে দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে আরও ঋণের সন্ধান করছে। তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হচ্ছে, মিসর এমন এক সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি হারিয়েছে, যখন সে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। এসব কারণে বিদেশি বিনিয়োগ ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করা কঠিন হবে। অথচ মোবারকের আমলে মিসরে প্রচুর পর্যটক আসতেন। সিনাওয়ে বলেন, ইকোনমিস্ট যা বলেছে তা হলো, মিসরের অর্থনীতিবিদেরা এই সংকট মোকাবিলায় একেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন, যার কারণে ‘মিসর ধ্বংস হতে বসেছে’।
মিসরীয় সাংবাদিকেরা আসলে বলছেন, বিদেশি গণমাধ্যমে এসব নিবন্ধ এমন সময়ে প্রকাশ করা হয়েছে, যখন সিসির ওপর রাজনৈতিক চাপ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাঁরা আরও বলেন, তার মানে এই নয় যে, এই জঘন্য ভুল করা মিসরের জন্য জায়েজ, যার জন্য পশ্চিমারা তাঁকে আক্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এটা মাথায় রাখা দরকার, ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দিয়েছে, মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য ও সাংবাদিকেরা, যাঁরা মিসরে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তাঁরা ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে পারেন। সিনাওয়ে বলেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ক্ষমতা গ্রহণের পর সিসি অভিনন্দন জানালে তিনি তাঁর জবাব দেন তিন সপ্তাহ পর।
পরিষ্কারভাবেই মিসর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, যার কারণ হচ্ছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হওয়া। পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, যদি ভবিষ্যৎ মার্কিন সরকারের সঙ্গে মিসরের সম্পর্ক খারাপ হয়।
মিসর সরকারের জন্য অর্থনীতিই এখন বড় সমস্যা। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক হাজেম হোসনি বলেছেন, ইকোনমিস্ট সিসির অর্থনীতির সমালোচনা করেছে এ কারণে, এটি অনুদান ও সাহায্যনির্ভর। একই সঙ্গে সে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিচ্ছে। আসলে ইকোনমিস্ট-এর এই ‘মিসরের ধ্বংস’ শীর্ষক নিবন্ধ ছাপানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, সিসিকে ক্ষমতা থেকে হটানো বা তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে না দেওয়া। এটা ভালো লক্ষণ নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো সিসিকে চাপ দিয়ে ডিস্কো নাচ নাচাতে চাচ্ছে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কামাল গাবালা: মিসরের আল আহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।