নগদ সহায়তাই কোভিডের অভিঘাত মোকাবিলার পথ

করোনার মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি জনমনে প্রশ্ন: প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিতীয় ধাক্কায় কি অভিঘাত বেশি? প্রথম ধাক্কার পর আশা-জাগানিয়া দেশব্যাপী টিকা কার্যক্রম শুরুর পর অভিঘাত কতটুকু কমেছিল? সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোয় ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে কি না? নতুন দারিদ্র্য কমেছিল কি না? নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে? এখন কোন পথে অর্থনীতি?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত বছরের ১৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: জীবিকার ওপর অভিঘাত ধারণা জরিপ’ করেছিল। ৬৮ শতাংশ পরিবার আর্থিক সংকটে পড়ে। ৪৬ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালিয়েছে। আত্মীয়স্বজনের সহায়তা নিয়েছিল ৪৩ শতাংশ পরিবার। ২১ শতাংশ পরিবার সরকারি ত্রাণ বা অনুদান পেয়েছিল। জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখেছিল ১১ শতাংশ পরিবার। পরিবারপ্রতি আয় কমেছিল গড়ে ২০ শতাংশ। চার মাসের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা ১০ গুণ বেড়েছিল। এক দিন আয় না হলে সংসার চালানো দায়—দিন আনে দিন খায়—অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষই বেশি। সঞ্চয় নেই বললেই চলে; এখন কোথায় ধার পাবে? আগের ঋণই কীভাবে শোধ হবে?

মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দ্রুত সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিকস ও ইভালুয়েশন প্রক্ষেপণ করেছে। দুঃখজনক, বাংলাদেশে আগামী জুন মাস নাগাদ পর্যন্ত প্রতিদিন মৃত্যুহার বাড়বে। মাস শেষে ৭১ হাজার ৭২৬ জনের মৃত্যুর প্রক্ষেপণ শঙ্কাজনক।

প্রথম ধাক্কা এখনো কাটেনি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার জরিপ জানিয়েছিল, প্রথম ধাক্কায় দেশের ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। অন্যদিকে, করোনাকালে হতদরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্যাকেজের অর্ধেকের বেশি এখনো অবণ্টিত। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৩টি, প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষাসংক্রান্ত সাতটি প্যাকেজে বরাদ্দের পরিমাণ ১০ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। মাত্র ৪ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে। প্রায় ৫৬ শতাংশ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। দ্বিতীয় ধাক্কায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকায় অভিঘাত আরও বেশি পড়বে। প্রথম ধাক্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বাস্থ্যসেবায়ও অগ্রগতি হয়নি; সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি।

কার্যকর নীতি-কৌশলের জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ের পরিসংখ্যান। সেকেলে তথ্য, তথা বছরওয়ারি হিসাব দিয়ে কোথায়, কখন, কী ধরনের কৌশল ও ব্যবস্থা, তা নেওয়া সম্ভব না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে গণনা করা হয়। যেমন পরপর দুই ত্রৈমাসিকে একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সংকোচন ঘটলে দেশটিকে মন্দাক্রান্ত বলা হয়।

নজির আছে
নিয়মিত তথ্য প্রকাশের নজির বাংলাদেশে আছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি, রপ্তানি, অভিবাসী আয়ের তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো প্রতি মাসেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে রপ্তানির মাসিক হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে অভিবাসনের পরিমাণ জানা যায়। অর্থবিষয়ক মন্ত্রণালয় সরকারের আয়-ব্যয়, তথা রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে মাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এনবিআর নিয়মিত রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি অবহিত করে। পরিকল্পনা কমিশন নিয়মিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির তথ্য দেয়। সমন্বয়ের মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক হিসাব তিন মাস অন্তর প্রকাশ কঠিন নয়।

কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়েছে
বিবিএস প্রতি মাসেই মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করত। ওঠানামাটা সহজেই জানা যেত। হঠাৎ তথ্য প্রকাশ ত্রৈমাসিক করে ফেলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছয় মাস অন্তর মুদ্রানীতি প্রণয়ন করত। গত বছর থেকে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণার নিয়ম করেছে। মূল্যস্ফীতির মাসিক তথ্য প্রকাশ এবং মুদ্রানীতি ষাণ্মাসিক ভিত্তিতে প্রণয়ন করা গেলে অর্থনীতির গতিপথ সহজে বোঝা যেত।

ত্রৈমাসিক হালনাগাদের প্রক্রিয়া
সব বৃহৎ ও উদীয়মান অর্থনীতি ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি হিসাব করে। প্রতিটি ত্রৈমাসিকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকায় তা করা হয়। একে অর্থনীতিবিদেরা ‘সিজনালিটি’ বলে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, এখন দেশে খাদ্য মজুত কম আছে। কিন্তু এপ্রিলে বোরো ধান ঘরে তোলা হলে খাদ্য মজুত বাড়বে। কৃষকের আয়ও বাড়বে।

পরিসংখ্যানবিদেরা সিজনালিটি নিয়ে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কাজ করে চলেছেন। দুই দশক ধরে অনেক পরিসংখ্যান সংস্থা (যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস বা আদমশুমারি ব্যুরো) ‘ডিসিজনালাইজিং’ পদ্ধতি অবলম্বন করে নিয়মিত তথ্য প্রকাশ করছে। এ পদ্ধতিকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বাজারে প্রাপ্ত স্ট্যাটিস্টিক্যাল প্যাকেজগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি পাওয়া যায়। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর এক্স-১২ পদ্ধতি। বিবিএস কাস্টমাইজ করতে পারে।

২০১৩ সালের পরিসংখ্যান আইনে আগের পরিসংখ্যান কাউন্সিল বাদ পড়লেও পরিসংখ্যান-ব্যবস্থাকে ‘বিশ্বমানে’ উন্নীত করার লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি জাতীয় পরিসংখ্যান উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছে। বলা হয়েছে, জনগণের প্রয়োজন দেখে করা হবে জরিপ। দ্রুত পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

পদ্ধতিরও সংস্কার জরুরি
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য-উপাত্ত এবং হিসাবের পদ্ধতি আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রেই হিসাবপদ্ধতির যুগোপযোগীকরণ দরকার। উদাহরণস্বরূপ, করোনার আগেই জিডিপিতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অংশ স্থবির, বেকারত্ব বেড়েছে, কর্মসংস্থান কমেছে, শ্রমিকদের প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছে, এত কিছুর পরও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব সংগত কারণেই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। খাতওয়ারি হিসাবপদ্ধতিরও সংস্কার দরকার।

যেমন, কৃষিতে ফসলের মূল্য সংযোজনের হিসাবে বিবিএস উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য উপকরণ—সার, কীটনাশক, সেচ প্রভৃতির তথ্য সংগ্রহ করে না। উৎপাদন উপকরণের সুনির্দিষ্ট ও প্রকৃত তথ্যের পরিবর্তে মূল্য সংযোজন নিরূপণ কতটা যুক্তিযুক্ত? উপরন্তু, অঞ্চলভেদে জলবায়ু এবং অবকাঠামোগত তারতম্য থাকায় উৎপাদন উপকরণের খরচও ভিন্ন। একই রকম সীমাবদ্ধতা দেখা যায় শিল্প খাতেও। পদ্ধতির সংস্কারের মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পরিসংখ্যানের প্রকাশ জরুরি। একইভাবে ত্রৈমাসিক শ্রম জরিপ জরুরি।

নতুন ঢেউ, তথ্য ও নীতি-কৌশল
প্রথম ও দ্বিতীয় ধাক্কার বাস্তবতা ভিন্ন। পরিপ্রেক্ষিতের পার্থক্যে আগের কৌশল কাজ করবে না। দ্রুত কার্যকর জরুরি ব্যবস্থা ও চলমান উদ্যোগগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন মাত্রা যুক্ত করার পাশাপাশি কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা মোকাবিলায় সুদূরপ্রসারী সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা স্থাপন এবং নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

অভিঘাত মোকাবিলায় প্রতিটি মানুষের কাছে নগদ সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সর্বজনের কাছে অর্থ পৌঁছালেই অর্থনীতির চাকা ঘুরবে। দ্রুত দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা সম্ভব হবে।

অর্থনৈতিক সূচকসমূহের ঊর্ধ্বগতি ও অধোগতি সম্পর্কে সঠিক ও সর্বশেষ তথ্য থাকলে করোনা সংক্রমণের মাত্রার সঙ্গে তুলনা করে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিরও প্রক্ষেপণ করা যেত। অর্থনীতিতে কখন কেমন প্রভাব পড়বে, তা অনুমান করা যেত। একইভাবে কৌশলের কার্যকারিতা জানা যেত। উদাহরণস্বরূপ, গাড়ির স্পিডোমিটার গাড়িটি চলার বর্তমান গতি বলতে পারে না। শুধু ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়লেই আগের চেয়ে গতি কমায়। গাড়ির চালক জানেন না গাড়িটির গতি কখন কতটুকু বাড়ছে বা কমছে। ফলে, তার পক্ষে সঠিক সময়ে গতি বাড়ানোও সম্ভব হয় না। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির ক্ষেত্রেও নিয়মিত হ্রাস-বৃদ্ধির তথ্য জানা না থাকলে সঠিক নীতি-কৌশল প্রণয়ন দুরূহ।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন।
[email protected]