নগর-নিসর্গের আহাজারি

সৌন্দর্যবর্ধনে বনসাই লাগানো হয়েছে
সৌন্দর্যবর্ধনে বনসাই লাগানো হয়েছে

১৮ মে টেলিভিশনের একটি চ্যানেলের টক শোতে ঢাকা শহরের সৌন্দর্যায়ন নিয়ে একটি আলোচনা দেখছিলাম। আলোচকেরা বারবার বলছিলেন, বিমানবন্দর সড়কের পাশে বনসাই লাগানো হচ্ছে। সড়কের পাশে কোথাও বনসাই লাগানোর কোনো তথ্য আমার জানা নেই। যদি ভুল না হয়ে থাকে, ওই গাছগুলো বনসাই নয়, এক জাতের খাটো রঙ্গন, চীনা রঙ্গন। কেউ কেউ বলছিলেন, ওখানে এ ধরনের কোমল সৌন্দর্যচর্চা না করে বড় বড় গাছ লাগানো উচিত। কেননা, আমাদের শহরের কংক্রিট অরণ্যে সবুজ বড়ই কম, দূষণ ও তাপ অত্যধিক, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে।

আমি তাঁদের সঙ্গে একমত। একসময় এয়ারপোর্ট রোডের এক পাশে নাগেশ্বরের একটি লম্বা সারি ছিল। চমৎকার। প্রায় কৌণিক চিরসবুজ বৃক্ষ, ডালপালা ছড়ায় না, সুগন্ধি ফুল ফোটে, পথপাশে রোপণের জন্য আদর্শ। গণপূর্ত বিভাগের জনৈক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিজ উদ্যোগে ভারত থেকে ট্রাকে বোঝাই করে চারা এনে এগুলো লাগিয়েছিলেন বলে শুনেছি।

বিএনপির সরকারের আমলেও একবার ওই পথের সৌন্দর্যায়ন হয়েছিল। প্রায় একই ধাঁচে। ডেলিকেট ল্যান্ডস্কেপিং। শোনা গিয়েছিল, ওই সময় কিছু নাগেশ্বরগাছ রাতের অন্ধকারে লোপাট করে দিয়ে মহার্ঘ্য বিদেশি গাছ লাগানো হয়েছিল। সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে নাগেশ্বরগাছ যে কমেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। এবার নাকি এই গাছের সংখ্যা আরও কমেছে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে নবগঠিত এই প্রদেশের রাজধানী হয়েছিল ঢাকা। মন্ত্রিপাড়ার সুন্দর বাড়িগুলো তখন নির্মিত হয়েছিল ইংরেজ আমলাদের জন্য। লন্ডনের কিউ গার্ডেনের উদ্যানিক আর এল প্রাউডলককে আনা হয়েছিল নতুন রাজধানীর বৃক্ষশোভা নির্মাণের জন্য। তিনিই রমনা গ্রিনের স্থপতি। রমনা গ্রিন বলতে বোঝায় রমনা পার্ক বাদে গোটা রমনা এলাকা, সেক্রেটারিয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নীলক্ষেত।

এখনো তার সামান্য কিছু অবশিষ্ট আছে হেয়ার রোড, মিন্টো রোড চত্বরে। বলধা গার্ডেনের তত্ত্বাবধায়ক অমৃত লাল আচার্য আমাকে জানিয়েছিলেন, বর্তমান সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে ছিল সারি সারি কনকচূড়া (পেল্টোফরাম), যার শেষ নমুনাটি আমি ষাটের দশকের শুরুতে জিরো পয়েন্টের পাশে দেখেছি। এক সারি সিলভার লিফ ওক ছিল কার্জন হলের সামনের সড়কে, নিউমার্কেটের পাশে ছিল বটের একটি সারি। এগুলো আর নেই। প্রাউডলক দেশি-বিদেশি গাছের চমৎকার মেলবন্ধন ঘটিয়ে যে বৃক্ষশোভা নির্মাণ করেছিলেন, তা আজও নগর–নিসর্গ পরিকল্পনার আদর্শ হয়ে আছে।

বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১২) না হলে ঢাকা একটি উদ্যাননগর হতো, যার আদল আজও টিকে রয়েছে রমনা গ্রিনে। আজ শহরে যাঁরা গাছ লাগান, তাঁরা প্রাউডলককে ভুলে গেছেন। তাঁর পরিকল্পনা তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন না, করলে মিন্টো ও হেয়ার রোডের বৃক্ষশোভার ফাঁকে ফাঁকে মেহগনি লাগাতেন না।

প্রাউডলক কি ঢাকায় নাগেশ্বর লাগিয়েছিলেন? সঠিক জানি না, তবে ষাটের দশকে আমি সিদ্ধেশ্বরীতে এক সারি বয়স্ক নাগেশ্বরগাছ দেখেছি, হয়তো প্রাউডলকেরই লাগানো। কারণ, সিদ্ধেশ্বরীতে তখন কয়েকটি প্রকাণ্ড রেইনট্রি (মেঘশিরীষ) ও গগনশিরীষগাছ ছিল এবং হলি ফ্যামিলি রোডে ছিল গ্লিরিসিডিয়া। শালগাছ ঢাকা শহরে দুষ্প্রাপ্য, তবে তার আত্মীয় তেলশুর আছে অনেকগুলো। অবশ্যই প্রাউডলকের নির্বাচন।

প্রাউডলক তাঁর নির্মাণ অসমাপ্ত রেখেই বিদায় নেন। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত কাজটি চালিয়ে যান তাঁর যোগ্য সহকারী পুরানা পল্টনবাসী অখিল চন্দ্র চক্রবর্তী। তৎকালে ঢাকা মহানগর গার্ডেন-সিটি হলে অবশ্যই সেখানে স্থান পেত আমাদের বনজ সুদর্শন বৃক্ষরাজি। গাব গোত্রের গাছপালা যেমন চিরসবুজ, তেমনি গড়নের দিক থেকেও ভারি নজরকাড়া।

বিদেশের বোটানিক গার্ডেনগুলো এ ধরনের গাছগাছালি নগর–নিসর্গ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জোগান দেয়। আমাদের বোটানিক গার্ডেন কাজটি করে কি না, জানি না। ওই টক শোতেই একজন আলোচককে বলতে শুনেছি, এই সৌন্দর্যায়নের জন্য নাকি চীন থেকে তিন কোটি টাকা খরচ করে গাছ আনা হচ্ছে। দৃষ্টির এই দারিদ্র্য আমাদের কবে ঘুচবে, জানি না। বিমানবন্দর সড়কের বৃক্ষরোপণ সম্পর্কে আমার মত হলো, দুই পাশে শক্ত-সমর্থ লম্বাটে এক সারি বা দুই সারি গাছ লাগানো যেতে পারে। যেমন নাগেশ্বর, নাগলিঙ্গম, তেলশুর, দেশি দেবদারু, দইগোটা, শাল, বনবৃক্ষ গুলাল (Diogpuros toposia) ইত্যাদি। এবং প্যারিসের সাজেঁ লিজেঁর মতো মিড-আইল্যান্ডে যতগুলো ডেলিকেট ল্যান্ডস্কেপি। তবে দেখছি, মিড আয়ারল্যান্ডে ইদানীং এত ঘনবন্ধ লতাগুল্ম লাগানো হচ্ছে, যার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে গিয়েছিলাম জয়দেবপুর হয়ে। পথের দুই পাশে তৈরি পোশাক কারখানার স্তূপীকৃত বর্জ্য, মাথাসমান উঁচু। জানি না এগুলো কত দিন এভাবে থাকে। মহাসড়কে উঠে দেখলাম বিশাল মিড-আইল্যান্ড, তাতে লাগানো বড় ও মাঝারি বৃক্ষ এবং প্রচুর লতাগুল্ম। যাঁরা সড়ক নির্মাণ করেছেন, তাঁরা অবশ্যই দক্ষ, কিন্তু গাছপালা লাগানো হয়েছে যদৃচ্ছা, কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, নিতান্ত দায়সারাভাবে।

কাজটা কি এতটাই ফেলনা? সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষকে এটাই আমার জিজ্ঞাসা। যেমন শহরে, তেমনি দেশের মহাসড়কে গাছ লাগানোও একটি মহাপরিকল্পনার বিষয়। এসব সড়কের পাশে ও মাঝখানে কী কী গাছ লাগানো হবে, সে জন্য কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা আবশ্যক। আমি দীর্ঘকাল রাশিয়ায় ছিলাম। সড়কপথে শত শত মাইল ঘুরেছি, মিড-আইল্যান্ডে কোনো গাছ দেখিনি। লন্ডন থেকে ম্যানচেস্টারে যাওয়ার পথেও না। রাশিয়ায় রেলপথ ও সড়কপথের দুই পাশে গাছ লাগানো হয় মূল রাস্তা থেকে অন্তত সাত-আট মিটার দূরে, মধ্য উচ্চতার কয়েক সারি গাছ, বেশির ভাগই বুনো ফল। কিশোরদের দল সেই ফল খায়। ব্রিটেনের হাইওয়েগুলোতে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ, দুই পাশে বেড়া, পারাপারের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বে পুল আছে।

মহাসড়কের পাশে বা মাঝখানে গাছ লাগানোর ব্যাপারে নানা কর্তব্য থাকে। প্রথমে সড়ককে ছায়াচ্ছন্ন না করা, যানবাহনের নিরাপত্তা এবং শেষে অর্থনৈতিক ও নান্দনিক বিবেচনা। শুনেছি বজ্রপাত থেকে সুরক্ষার জন্য দেশে ১০ লাখ তালগাছ লাগানো হবে। কিন্তু পথের ধারে তালগাছ লাগানোর সমস্যা হলো মা-গাছ থেকে তাল পড়ে পথচারীর আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

আমাদের দেশে সড়ক থেকে সাত-আট মিটার দূরে গাছ লাগানোর তেমন সুযোগ নেই। যদি মিড-আইল্যান্ডে গাছ লাগাতেই হয়, সে ক্ষেত্রে ভেষজ বৃক্ষের কথা বিবেচ্য হতে পারে। কিংবা অন্যতর বিকল্প কিছু। লাগানো যেতে পরে অনেক দূর পর্যন্ত এক রঙের ফুল কিংবা মিশ্র বর্ণের সজ্জা। কৃষ্ণচূড়া, কনকচূড়া, জারুল, সোনালু, কাঞ্চন, অশোক, আকরকাঁটা, উদাল, কলকে, কাঠগোলাপ, কুরচি, গাব, ছাতিম, নাগেশ্বর, কদম, পলাশ, লাল সোনালু, কনকচাঁপা (রামধনুচাঁপা) স্বর্ণচাঁপা, শেফালি, সুলতানচাঁপা, চালতা, হাড়গজা, হিজল ইত্যাদি। এমন গাছের জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।

শহরে ও মহাসড়কে গাছ লাগানো একটি বহুমুখী জটিল কর্মকাণ্ড আর এ জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেন ল্যান্ডস্কেপ স্থপতিরা, যাঁরা দেশ-বিদেশের গাছপালা চেনেন এবং সৌন্দর্য নির্মাণে সুদক্ষ। আমাদের ছাড়া ছাড়া ও দায়সারা কাজকর্ম
দেখলে মনে হয় এটা যে একটা ডিসিপ্লিন বা বিদ্যা, তা উপলব্ধি করতে আমরা আজও সম্যক সক্ষম হইনি।

দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।