নগরে নির্বাচন: 'ভোট না হাতি দেব'

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অফিসফেরত গাড়িঘোড়া ঢোকা শুরু হওয়ার আগেই বৈকালিক হাঁটা সেরে নিতে হয় আবাসিক এলাকার ভেতরের রাস্তায়। মাঠ নেই আশপাশে। পিচ্চিরা রাস্তার ওপর প্লাস্টিকের স্টাম্প বসিয়ে ক্রিকেট খেলে। বলের বাড়িও খেতে হয় মাঝেমধ্যে। ওরই মধ্যে শাঁ শাঁ করে বাইসাইকেল চালায় দামালগুলো। রাজনৈতিক দলের উঠতি পান্ডাদের জালের মতো ঝুলিয়ে দেওয়া প্রচারপত্রের খুলে পড়া দড়িতে আটকে এক শিশু সাইকেলচালক যানসুদ্ধ পড়ে গিয়ে আহত হলো। তখন চলন্ত রিকশায় মাইকে প্যারোডি বেজে চলেছে ‘এবার ঘুম ভাঙাইয়া দিল রে সিটি নির্বাচন, অমুক মার্কায় ভোট দিলে আসবে উন্নয়ন।’

রাজনীতি আর রাজধানী এখন একেবারে একাকার। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এত দূষিত রাজধানী আছে কি না, আমাদের জানা নেই। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে ২০২০ সালকে আমরা সগৌরবে ‘মুজিব বর্ষ’ ঘোষণা করেছি। এ মহান বর্ষটি উদ্‌যাপনে যেসব কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে, সেখানে পরিচ্ছন্ন নগর গড়ার কোনো অঙ্গীকার আছে কি না, জানা নেই। থাকলে যে হারে প্ল্যাকার্ডে-ব্যানারে-পোস্টারে-জনসংযোগে নগর ছেয়ে গেছে, সে রকম দেখা যেত না। এতকাল নির্বাচনী প্রচারণায় কেবল কাগজের পোস্টার দেখে এসেছি। এবার নতুন সংযোজন লেমিনেটেড পোস্টার। একে বাজারের পলিথিনের আগ্রাসনে আমাদের নদী-নালা-জলাশয়-নর্দমা-মাটির স্বাভাবিক ধর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তার ওপর কোটি কোটি পোস্টার মোড়ানো পলিথিনে নগর সয়লাব হয়ে আছে। ভোট শেষে বিক্ষিপ্ত পলিথিনে দুরবস্থা আরও দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা।

প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা বাজারঘাটসহ আবাসিক এলাকাতেও সমানভাবে বিস্তৃত। লেমিনেটেড পোস্টারের মতো বাংলা লোকগানের প্যারোডি এবার নতুনভাবে প্রচারণায় ঝড় তুলেছে। একই সঙ্গে বক্তৃতা ও মিছিলের লাগাতার চিৎকার-চেঁচামেচি। তাদের গালভরা প্রতিশ্রুতি যে নেহাতই ফাঁকা বুলি, তা পাগলেও বোঝে। আবাসিক এলাকার অসুস্থ, বয়স্ক, বিশ্রাম ও অধ্যয়নরত মানুষ বিরক্তির একশেষ। তাঁরা মুখ ব্যাদান করে বলছেন ‘ভোট না হাতি দেব’।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পৃথিবীর ১ নম্বর যানজটের নগর ঢাকার রাস্তা মিছিল-মিটিংয়ে ইদানীং একেবারে নট নড়নচড়ন। আর যানজট মানেই যানবাহনের প্রতিযোগিতামূলক ভেঁপুর আওয়াজ। যাঁদের কারণে এ নগরের দূষণ ও দুর্ভোগ চরমে, তাঁরা প্রতিটি জনসভায় নগর দূষণমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। আমাদের নির্বাচন কমিশন থেকে উন্নত বিশ্বে নির্বাচনী প্রচারণা ও নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণের জন্য সরকারি খরচে প্রতিনিধি প্রেরণ করা হয় দফায় দফায়। সম্প্রতি তারা কি কোথাও পলিথিনে মোড়া নগর ছাওয়া পোস্টার দেখে এসেছেন? এ অভিনব আবিষ্কারটি কার? নির্বাচনী বিধিমালায় নিশ্চয় পলিথিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা নেই। অথচ পরিবেশবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু এই পলিথিনের কারণেই ধ্বংস হতে পারে পুরো বাংলাদেশ। যেখানে রাজধানীর জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ অসচেতনভাবে ফেলে দেওয়া পলিথিন, সেখানে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিসংবলিত পলিথিন মোড়কের পোস্টার তো অগ্নিতে ঘৃতবর্ষণ। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের সূত্র ধরে বলা যায়, প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে মাছ ও জলজ প্রাণীর বসবাস ও বেঁচে থাকার জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি থাকা প্রয়োজন। অপর দিকে দ্রবীভূত হাইড্রোজেনের মাত্রা কমপক্ষে ৭ মিলিগ্রাম থাকা উচিত। অথচ বুড়িগঙ্গার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায়। এমন পানিতে কোনো জলজ প্রাণী বাঁচতে পারে না। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লাস্টিকদূষণে বিশ্বে দশম বাংলাদেশ। সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় এক কোটি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনেও পলিথিনের কুপ্রভাব লক্ষণীয়।

বাংলাদেশে পলিথিন উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার রোধে নাকি আইনও আছে। যাঁরা সে আইন মেনে চলার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবেন, সেই প্রতিশ্রুত জনপ্রতিনিধিরা একেকজন দূষণের হোতা। আপনি আচরি ধর্ম—প্রবাদটির সঙ্গে যাদের পরিচয়ই নেই। রাতে হোক, দিনে হোক নির্বাচন হয়ে যাবে। যাঁরা বিজয়ী হবেন তাঁরা তো করবেনই, পরাজিতরাও যাতে তাঁদের বীজ বোনার মতো বুনে দেওয়া পলিথিন, পোস্টার, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড জায়গামতো সরিয়ে নিয়ে রাজধানীটাকে বসবাসোপযোগী করে তোলেন, সেটার আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। মহান ‘মুজিব বর্ষে’ বিশ্বে দূষণমুক্ত রাজধানীর তালিকায় নিচের দিকে হলেও ঢাকার নামটা অন্তর্ভুক্ত হোক, জাতির জনকের জন্মশতবর্ষে নাগরিকদের পক্ষ থেকে এই সামান্য উপহার কি আমরা দিতে পারি না?

উম্মে মুসলিমা: কবি ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]