নজর দিতে হবে সুশাসন ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্প্রতি যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি দেশের রাজনীতি। ‘শাসন পরিস্থিতি, বাংলাদেশ ২০১৩: গণতন্ত্র, দল ও রাজনীতি’ শিরোনামের গবেষণা প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার অভাব এবং দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের কারণে দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাওয়া ও সুশাসনের সংকটের বিষয়গুলো বের হয়ে এসেছে। এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্প্রতি ‘দ্য স্টেট অব অব গভর্নেন্স বাংলাদেশ, ২০১৩’ শীর্ষক যে গবেষণা প্রতিবেদন পেশ করেছে, তা নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর অনেক উপাদানই বিবেচনার দাবি রাখে। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রসঙ্গ এ প্রতিবেদনে এসেছে, তাদের বিষয়গুলো ভেবে দেখা উচিত। এগুলো আমাদের জাতীয় পরিসরে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত হয়েছে। তবে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণার ফলাফল হিসেবে যখন এগুলো উঠে আসে, তখন এগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবনার অবকাশ সৃষ্টি হয়।

প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের ঘাটতির কথা বলা হয়েছে। এটা খুবই সত্য। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্ব নির্বাচন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব দিবালোকের মতো পরিষ্কার। ফলে দলগুলোর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড়ায়নি। এটা অনস্বীকার্য, রাজনৈতিক দলই সমাজের গণতান্ত্রিক উত্তরণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। তাদের মধ্যেই যদি গণতান্ত্রিক চর্চা বা সংস্কৃতি না থাকে, তাহলে সেই সমাজের গণতন্ত্রায়ণ সম্পন্ন হয় না। আমাদের দেশের নির্বাচনী আইনে গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ থাকলেও দলগুলো তা অনুসরণ করছে না। টিআইবির একটি প্রতিবেদনেও আমরা এ কথা বলেছিলাম।
আমাদের দেশের রাজনীতি হচ্ছে ‘জিরো সাম গেম’। এখানে যে জেতে সে–ই সব নিয়ে যায়, আর যে হারে তার ভাগ্যে কিছু জোটে না। ফলে সবারই লক্ষ্য থাকে, যেকোনো উপায়েই হোক ক্ষমতায় যেতে হবে অথবা ক্ষমতায় থাকতে হবে। অর্থাৎ জিততেই হবে। সে কারণে তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের ঝোঁক প্রবল। ফলে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো নষ্ট হয়েছে। দলীয়করণের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো তার সামর্থ্য ও সক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের দেশে ঠিক তা-ই ঘটেছে।
লক্ষ্য যখন থাকে যেভাবেই হোক ক্ষমতায় যেতে হবে, তখন আইনের শাসন ও সুশাসন বলে কোনো কিছু থাকা সম্ভব নয়। সুশাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনের শাসন। আইনের শাসন না থাকলে গণতন্ত্রের চেতনাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা শেষ পর্যন্ত মানুষের অধিকার খর্ব করে। আইনের রক্ষককে আমরা ভক্ষক হিসেবেও কাজ করতে দেখছি। আগে দেখা যেত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সরকার নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে। বহুদিন ধরেই এটা হয়ে আসছে।
কিন্তু ২০১৪ সালে আমরা এর নতুন মাত্রা দেখলাম। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাটি র্যা ব অর্থের বিনিময়ে ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ র্যা ব একরকম ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে দলীয় ও গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার হলে তাদের যেমন সক্ষমতা হ্রাস পায়, তেমনি তারা মানুষের আস্থাও হারায়। এ অবস্থায় মানুষ আইনের ওপর ভরসা না পেয়ে নিজ হাতেই আইন তুলে নেয়, যার কিছু নজির সম্প্রতি আমরা দেখেছি। গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথে এটা বিরাট বাধা।
জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের জায়গা হচ্ছে অর্থনীতি। শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিগত কয়েক বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। যে সরকারই আসুক না কেন, সবাই এ নিয়ে গর্ব করে। এমনকি আর্থসামাজিক সূচকেও আমাদের অবস্থান ভালো, অন্তত অনেক দেশের তুলনায় ভালো। সামাজিক সূচকে আমাদের অবস্থান ভারতের চেয়েও ভালো। কথা হচ্ছে, দেশে সুশাসন ও স্থিতিশীলতা থাকলে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত হতো। বিশেষত পরমতসহিষ্ণুতা থাকলে আমরা অনেক সংঘাত এড়াতে পারতাম। সেটা থাকলে আমরা আরও অনেক ওপরে যেতে পারতাম।
সুশাসন না থাকার ক্ষতি অনেক বেশি। এটা পরিমাপ করাও দুঃসাধ্য। সুশাসন না থাকায় আমরা যে কী হারাচ্ছি, তা আমরা নিজেরাই জানি না। দেশে সুশাসন কিছুটা হলেও নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ত, আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ত। আর এর সঙ্গে দুর্নীতিতে লাগাম দিয়ে তা মধ্যম পর্যায়ে আনা সম্ভব হলে আমাদের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের কোঠায় চলে যেত।
ফলে আমাদের দুটি দিকে নজর দিতে হবে: সুশাসন ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ। ব্র্যাক খুব পরিশ্রমসাধ্য কাজ করেছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এসব আমলে নিলেই তা সার্থক হবে।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।