নতুন নুসরাত, সায়মা আর শাহিনুরদের বাঁচাও

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আজ বছরের শেষ দিন। নানা আয়োজনে চলমান বছরকে বিদায় জানানো হবে প্রতিবারের মতো। বরণ করা হবে আরেকটি নতুন বছর। আতশবাজির উৎসবে মেতে উঠবে পুরো পৃথিবী। সারা বিশ্বের রাতের আকাশ আজ হবে আলোঝলমলে। রাতের আঁধার ভেদ করে আকাশ সজ্জিত হবে আতশবাজির বর্ণিল আলোকচ্ছটায়।

বাংলাদেশের রাতের আকাশও আজ সাজবে নতুন সাজে। তবে আতশবাজির উজ্জ্বল সে আলোকচ্ছটা কি আলোকিত করবে ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাতের বাড়ির আঙিনা? যে ঘরটিকে নুসরাত নিজেই আলোকিত করে রেখেছিলেন, সেই ঘরটিতে আর কখনো আলোর দেখা মিলবে না। ওয়ারীর ছোট্ট সায়মার কথা মনে আছে হয়তো অনেকের। ৭ বছরের সামিয়া আক্তার সায়মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। এইতো গত বছরও হয়তো ছোট্ট সায়মা নতুন বছরকে বরণ করতে বাবার সঙ্গে আতশবাজির উৎসবে মেতেছিল। কী লাভ হয়েছিল নতুন বছরকে বরণ করে! নতুন বছরটি আশীর্বাদ নয়, বরং অভিশাপ হয়ে এসেছিল সায়মার জীবনে। বর্বরতার শিকার হয়ে মৃত্যুকে মেনে নেওয়া ছোট্ট সায়মা অন্ধকার কবরে শুয়ে একা একা আজ রাতে কি দেখবে আতশবাজির উৎসব! তার ছোট্ট মনটি কি আজ প্রশ্ন করবে না কোন অপরাধে সে আজ মা-বাবার হাত ধরে পৃথিবীর আতশবাজির শোভা দেখা থেকে অনেক অনেক দূরে? চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হলো শাহিনুর নামে যে নার্সকে, তাঁর বাড়িতে নতুন বছরটি কী শুভ কোনো বার্তা নিয়ে আসবে? মনপুরার নির্জন চরপিয়ালে যে গৃহবধূকে ধর্ষণকারীদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পুনরায় ধর্ষণ করা হয়েছিল, তিনি কি তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেন নতুন বছরে! সুবর্ণচরের সেই মা ও তাঁর কন্যারা কি আজ রাতে ঘুমাতে পারবেন? 

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গণধর্ষণের শিকার নারীর অভিসম্পাত নিয়েই শুরু হয়েছিল ২০১৯ সাল। নারী নির্যাতনের ঘটনায় অপ্রতিরোধ্য ছিল ২০১৯ সাল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ১১৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৭ জনকে এবং আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন নারী ও শিশু। ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির তথ্য অনুসারে ২০১৯ সালের প্রথম ১০ মাসে দেশের ৫৪টি জেলায় নারী ও শিশুর প্রতি মোট ৯ হাজার ৯৮২টি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনার তথ্য রয়েছে। ডিসেম্বর নাগাদ ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা হয়তো দেড় হাজার ছাড়িয়েছে। তবে কয়টি ঘটনাই-বা প্রকাশিত হয় গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক মাধ্যমে!

শিশু ধর্ষণের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৯৬৯টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জানি না ২০২০ সাল নির্যাতনের শিকার এই শিশুদের জন্য নতুন কোন বার্তা নিয়ে আসবে কি না! এই শিশুরা শুধু ২০২০ নয়, সারা জীবনে তাদের দুঃসহ যন্ত্রণা হয়তো কখনোই ভুলতে পারবে না।

সুন্দর আর মঙ্গল কামনায় প্রতিবছর নতুন বর্ষকে বরণ করি আমরা। কিন্তু মেলে না মঙ্গলের দেখা, স্বস্তি পায় না নারী। চলতি পথে, ঘরের ভেতর, শিক্ষাঙ্গন, কর্মস্থলসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর দিকে ধেয়ে আসে মন্দ হাতের স্পর্শ। থামে না ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, পারিবারিক, নির্যাতন, যৌতুকের অভিশাপ। এই বাস্তবতায় শুরু হতে যাচ্ছে আরেকটি নতুন বছর। জানি না আসছে বছরের জন্য এরই মধ্যে মোট কতজন নারীর নাম উঠেছে নির্যাতিত হওয়ার অপেক্ষমাণ তালিকায়। সেই তালিকায় কখনো হয়তো অচিরেই ভেসে উঠবে আমার নিজের নামটি কিংবা প্রিয় সন্তান, মা, বোন, বান্ধবীটির নাম!

আতশবাজির উৎসব রাতের অন্ধকার আকাশ সাময়িকভাবে আলোকিত করলেও তা আলো ফেলে না নারীর চলার পথটিতে। সেটি যেন চাপ চাপ অন্ধকারে ঠাসা। সে অন্ধকার সরানো যায় না। গ্রহণ লাগা সেই অন্ধকার দিন দিন কেবলই প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে। নুসরাত, সায়মা কিংবা শাহিনুরের মতো কাউকে শিকার বানানোর প্রস্তুতি হয়তো শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এমনকি আজ রাতে আতশবাজির আলোকিত উৎসবেও ভয়াল হাত খুঁজে ফিরবে নতুন শিকার। নতুন নুসরাত, সায়মা আর শাহিনুরদের বাঁচাবে কে?

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক