নতুন বছরে কী কী চাই

রাজধানীতে ২০২১ উদযাপনছবি প্রথম আলো

নতুন বছর শান্তিময়, সুখের, সমৃদ্ধির হোক। কোভিড-১৯ অভিঘাতে ২০২০ সালে মানুষ জীবন ও জীবিকার শঙ্কার মধ্য দিয়ে গেলেও নতুন বছরে আশার বাণী শুনতে চায়। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বছরের পাঁচটি প্রত্যাশার কথা উল্লেখ করা হলো।  

গণতন্ত্রের গতিময়তা  
২০২০ সালে গণতন্ত্রের নিম্নমুখী গতি প্রকটতর হয়েছে। ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের ৬৭টি দেশে গণতন্ত্রের সূচক নিম্নগামী। কোভিড–১৯ মহামারির কারণে অনেক দেশে নির্বাচন পিছিয়ে গেছে। অনেক দেশে বিভাজন ও জনতুষ্টির রাজনীতি আরও প্রকট হয়েছে। কিন্তু এই শাসকেরা গণতান্ত্রিকভাবেই নির্বাচিত হচ্ছেন! অন্যদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ-সংঘাত জারি রয়েছে। বাণিজ্যযুদ্ধও চলেছে। বহুপাক্ষিকতা থেকে এককেন্দ্রিকতার দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতাও দৃশ্যমান। মহামারিতে ১৮ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। অগণিত মানুষ বেকার হয়েছেন। আয় কমেছে; দারিদ্র্য বাড়ছে। আবার মুষ্টিমেয় লোকের সম্পদ বেড়েছে।

আশার কথা, ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসের টিকা প্রয়োগের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামীতে সবাইকে টিকার আওতায় আনা গেলে মানুষের চলাচল, যোগাযোগ বাড়বে। বাড়বে নিজেদের ক্ষোভ, দুঃখ অথবা আনন্দ-উল্লাস প্রকাশের মাত্রা। মানুষ নিজেদের দাবিদাওয়া, গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার নিয়ে সমাবেশের সুযোগ পাবে। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রশাসন থেকে বহুপাক্ষিকতার দিকে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বড় দুর্যোগের পরে পুরাতনকে ভেঙে নতুন সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা জাগে। নতুন বছরে চলাচলের স্বাধীনতা ও বহুপাক্ষিকতা গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে নতুন গতিময়তা আনবে।

জলবায়ু, প্রাণ-প্রকৃতি ও বজায়ক্ষমতা    
বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং প্রকৃতি ও মানুষের পরস্পর–নির্ভরশীলতাকেন্দ্রিক উন্নয়নের নতুন আকাঙ্ক্ষা দেখা যাচ্ছে। বিশেষত যুবসমাজ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে এসে নবায়ণযোগ্য-পরিবেশবান্ধব জ্বালানির কথা বলছে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে অণুজীব নিয়ে নতুন সচেতনতা তৈরি হয়েছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রকৃতি ও প্রতিবেশের ভারসাম্যের গুরুত্ব অনুধাবনের সুযোগ এসেছে। নতুন বছরে যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ুসংক্রান্ত প্যারিস চুক্তিতে ফিরে আসার কথা বলেছে। ২০৬০ সালের মধ্যে চীন কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় আনার সংকল্পের কথা জানিয়েছে।

২০২০ সালে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ২০২১ সালের নভেম্বরে গ্লাসগোতে ওই সম্মেলন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে বিশ্বনেতাদের ‘আমাদের গ্রহ রক্ষা করার’ নতুন প্রত্যয়ের সুযোগ তৈরি হবে। প্যারিস চুক্তির আলোকে বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২° সেলসিয়াস ডিগ্রির নিচে রাখা এবং ১.৫ সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করার প্রচেষ্টা গতি পেতে পাবে। উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা না রেখেই ক্ষতিগ্রস্ত।

পিছিয়ে যাওয়া বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য সম্মেলনও (সিবিডি-কপ-১৫) নতুন বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে চীনের কুনমিংয়ে হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ সম্মেলন থেকে ২০৫০ সালকে লক্ষ্যে রেখে ‘লিভিং ইন হারমনি উইথ নেচার’ বা প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বসবাসের নতুন যাত্রাপথ সুগম হতে পারে। এ সম্মেলনগুলোর মাধ্যমে ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের প্রচেষ্টাও গতি পাবে।

প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবনার পথ প্রশস্ত হচ্ছে। বিশেষত জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর এবং প্রকৃতি-পরিবেশ বিধ্বংসী প্রযুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে টেকসই উন্নয়নের পথ খোঁজার ব্যাপারে জনসমর্থন বেড়েই চলছে। মানুষ ও প্রকৃতি-পরিবেশকে প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা থেকে বেরিয়ে প্রযুক্তিকেই বরং মানুষ ও প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর দিকে যেতে হবে।

বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রিকতা জায়মান। মূলত হলিউড, বলিউড বা চীনকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিদ্যমান। এতে সংস্কৃতির ভাঙা সেতু সবার সঙ্গে যূথবন্ধন করতে পারছে না। চিন্তা ও চৈতন্যের অচলায়তন প্রকট। জাবরকাটায় সৃজনশীলতাও খাবি খাচ্ছে। সংস্কৃতি বহুলাংশে আধিপত্য বা হেজিমনি বিস্তারের বাহনে পরিণত হয়েছে। সংস্কৃতির ডিঙিতে চড়ে রাজনৈতিক লাভের জন্য উগ্র জাতীয়তাবাদকেও উসকে দেওয়া হয়েছে। জনতুষ্টিবাদিরা সংস্কৃতির এক বাহন ধর্মকে ব্যবহার করে সংঘাত তৈরি করছে। বর্ণগত বা নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় ব্যবহার করে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। ‘শ্রেণি’র সর্বজনীন অর্থকে বিকৃত করে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভয়ের সংস্কৃতির ডালপালাও বিস্তৃত। একচেটিয়াতন্ত্র গেঁড়ে বসেছে।

মূল্যবোধ, প্রথা, রেওয়াজ ইত্যাদি সাংস্কৃতিক উপাদান অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানকে আকার দান করে। অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমানুষের আচার-আচরণ এবং আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও সক্ষমতা ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে। এভাবে রাষ্ট্র, উৎপাদন ব্যবস্থা, পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক, পরিবেশ ও মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তুসংস্থান, ধর্মীয় ও জাতিগত সহনশীলতা ইত্যাদি অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা নির্ধারিত ও প্রভাবিত হয়। আশা করা যায়, বৈচিত্র্যপূর্ণ সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসার বিশ্বব্যাপী নতুন ধরনের সমাজ কাঠামো তৈরির আকাঙ্ক্ষা জাগাবে। মানুষে মানুষে সহনশীলতা, গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই বাংলাদেশ একটি সর্বজনীন নাগরিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিভেদ কাটিয়ে একটি মানবিক মর্যাদাপূর্ণ, সমতাভিত্তিক, ন্যায়বিচারভিত্তিক গণতান্ত্রিক নাগরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা।

শান্তিপূর্ণ বঙ্গোপসাগর
বঙ্গোপসাগর এ অঞ্চলে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। এ সাগরকে কেন্দ্র করে নতুন অস্থিরতা চেষ্টার প্রবণতাও জায়মান। সংঘাতমূলক আশঙ্কার বিস্তার লক্ষণীয়। পরাশক্তিগুলোর আধিপত্যের প্রতিযোগিতা এবং তাদের সঙ্গে জোটভুক্তির চেষ্টা এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও অস্থিরতার কারণ।

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এ দুই বিশ্বশক্তির মধ্যকার আন্তসম্পর্ককে বড় খেলোয়াড়দের বৈরিতার খেলায় পরিণত করে এই অঞ্চলকে সংঘাতময় করে তুলতে কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এরা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি ব্যাহত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বা চীন—যেকোনো একদিকে ভিড়তে উত্ত্যক্ত করছে। আবার কেউ কেউ দুদিকেই সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করতে আহ্বান জানাচ্ছে। পরস্পর ক্ষমতা ও দাম্ভিকতার প্রদর্শন এবং বহুপাক্ষিকতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে অস্থিরতা বাড়তেই থাকবে। এ ধরনের প্রবণতা বড় সংকটেরও জন্ম দিতে পারে।

অন্যদিকে এ অঞ্চলের দেশগুলো যদি নিজেদের মধ্যে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথা—উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সবদিকেই উৎপাদন, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়, তবে বহুপাক্ষিকতার ভিত্তিতে সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। এ জন্য বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে দাম্ভিকতা থেকে বেরিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ, বহুপাক্ষিক উন্নয়নমুখীন শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে।

সর্বজনীন বাংলাদেশ
১৯৭১ এবং ২০২১ সালের ইংরেজি পঞ্জিকার দিন, মাস, সময় কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ যেন ফিরে গেল তার জন্ম বর্ষে! নতুন বছরে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে ঘোষিত তিনটি মূলস্তম্ভ তথা—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আলোকে একটি সর্বজনীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জনগণকে প্রদত্ত সবচেয়ে বড় উপহার হবে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই বাংলাদেশ একটি সর্বজনীন নাগরিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিভেদ কাটিয়ে একটি মানবিক মর্যাদাপূর্ণ, সমতাভিত্তিক, ন্যায়বিচারভিত্তিক গণতান্ত্রিক নাগরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা।

এ জন্য প্রয়োজন নতুন ও বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল চিন্তা, নীতি ও আইনের সমন্বয় এবং দূরদর্শী রাজনীতি ও সঠিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ যেকোনো সংকট, বঞ্চনা, অধিকারহীনতা মোকাবিলা করতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নতুন বছরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেও তারা নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়াবে।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’–এর চেয়ারপারসন
[email protected]