নতুন বছরের শুরু, আজ কী চাই

পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা  (ফাইল ছবি)
পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা (ফাইল ছবি)

বৈশাখ একটা নতুন বছরের ঘোষণা দেয়, যে ঘোষণাটি আসে বজ্রের শব্দে, মেঘের ডাকে, প্রকৃতির রং বদলে, এর মেজাজের পরিবর্তনে। প্রতি দুই মাস পর এ দেশে ঋতুবদল হয়, কিন্তু আর কোনো ঋতুবদল এত সশব্দ হয় না, এতটা আড়ম্বরে উদ্‌যাপিতও হয় না, যেন প্রকৃতি চায় মানুষ এই শব্দের কোলাহলের এবং আড়ম্বরের অর্থটা বুঝুক, এদের প্রতীকী এবং প্রত্যক্ষ তাৎপর্য অনুভব করুক। এসবের একটা সারাংশ করলে দেখা যাবে, এদের কেন্দ্রে আছে জঙ্গম, পরিবর্তন এবং শুদ্ধি। কালবৈশাখী ধ্বংস বয়ে আনে, কিন্তু নতুন নির্মাণের শক্তিটাও তা মানুষকে দেয়। প্রতিবছর নতুনের প্রতিষ্ঠা একটা সংকল্প হিসেবে দেখা দেয় বাঙালির মনে।

নতুন বছরের শুরুতে গ্রামগঞ্জের দোকানে-আড়তে-গদিতে হালখাতা খোলা হয়, সেখানে নতুন কালিতে হিসাব লেখা হয়। মানুষও কাজকর্মের হিসাব নেয়। সেই হিসাবে লাল কালির কোনো দাগ যেন না পড়ে, মানুষ তা চায়। ব্যক্তি মানুষের যেমন, সমাজেরও তেমন অনেক চাওয়া–পাওয়ার হিসাব থাকে, নতুন বছরে যেগুলো অনেক তাড়া নিয়ে হাজির হয়। সমাজও চায় লাল কালির আঁচড় বাঁচিয়ে প্রত্যাশার ফর্দটা পুরো মাত্রায় মিলিয়ে নিতে। কিন্তু বছর শেষে দেখা যায়, লাল কালির দাগ থেকে বছরটা বাঁচানো যায়নি। অনেক চাওয়া অপূর্ণ রয়ে গেছে, অনেক পাওয়া হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। এবং আরও হতাশার যা, এমন অনেক কিছু সমাজের ঝুলিতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যা তাকে নৈতিকভাবে নিঃস্ব করে দিতে পারে।

‘আজ চাই কি’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘আজ চাই, ভরাট-জমাট জীবনের সহজ, স্বচ্ছন্দ, সতেজ গতি ও অভিব্যক্তি। কোথাও কোনো জড়তা, অজ্ঞতা, অক্ষমতা ও আড়ষ্টতা যেন না থাকে। আজ পথের বাধা পাষাণ অটল হিমাচলের মতো বজ্রদৃঢ় হলেও সত্য-সাধকের পদাঘাতে চক্ষের নিমেষে চূর্ণিত হবে।’ তিনি সেদিন যা চেয়েছিলেন, আজ আমরাও তা–ই চাইতে পারি। আমরা প্রশ্ন করতে পারি, আমাদের জীবন কি ভরাট-জমাট, তার গতি আর অভিব্যক্তি কি সহজ, স্বচ্ছন্দ ও সতেজ? আমাদের জীবনে উন্নয়নের স্পর্শ লেগেছে, প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়ছে, কিন্তু বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। ধনী আরও ধনী হচ্ছে, কিন্তু হতদরিদ্রের সংখ্যাও তো কম নয়। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সঙ্গে নিম্নবিত্তের ফারাক প্রকট। তাতে জীবনের গতি স্বচ্ছন্দ হয় না। জড়তা আর অজ্ঞতা সক্ষমতার বৈশ্বিক দৌড়ে আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে; আমাদের শিক্ষা এখন জ্ঞান উৎপাদন না করে মুখস্থবাজ পরীক্ষার্থীই শুধু উৎপাদন করছে। বৈষম্যপীড়িত ও অসম শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাস-সংস্কৃতি পাঠের দায়টা শুধু বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের ওপরই চাপানো হয়েছে, তা–ও খণ্ডিতভাবে।

আমাদের অক্ষমতার তালিকাটাও বেশ বড়। আমরা সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসীদের সুরক্ষা দিতে পারিনি, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারিনি, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি তৈরি করতে পারিনি। এখনো আমাদের নির্বাচনপদ্ধতি শুদ্ধ করার জন্য তত্ত্বাবধায়কের দাবি ওঠে। আমরা সত্য প্রকাশে আড়ষ্ট, ক্ষমতার সামনে আড়ষ্ট, দুর্বৃত্তদের হুংকারের নিচে আড়ষ্ট। এই আড়ষ্টতা কাটাতে সাহসের
পরিবর্তে আমরা স্তূতির চর্চা করি। ক্ষমতাকে সমীহ করে চলি, অন্যায় দেখলেও চোখ বন্ধ করে রাখি, তেলতেলে মাথায় আরও তেল ঢালি। এ জন্য আইনের লোকরাও আইন ভাঙে; দুর্বলের ওপর অবিচারের খড়্গ ওঠে।

আমাদের জড়তা, অজ্ঞতা, অক্ষমতা আর আড়ষ্টতা আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি এবং তা এক দিনে নয়। কত নববর্ষ এল আর গেল কিন্তু আমরা শুদ্ধি বা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করিনি। বরং আমাদের ভোগবাদ প্রবল হয়েছে, দুর্নীতিও পাখা মেলেছে। একাত্তরে আমরা অসীম সাহসে যুদ্ধ করলাম, সকলে মিলে একটি মানুষে দাঁড়িয়ে গেলাম। এত প্রাণ ঝরল, কিন্তু প্রতিটি মৃত্যুই ছিল বিশাল। একাত্তরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এই অভূতপূর্ব ঐক্য ধরে রাখব। গ্রামের মানুষ, যাঁরা তাঁদের দরজা খুলে রেখেছিলেন সকলের জন্য, তাঁদের সবকিছুর মাঝখানে রাখব। যা তা করতে পারবে, তার নাম সমাজতন্ত্র। সেটি আমাদের সংবিধানেও স্থান পেল। কিন্তু ওই পর্যন্ত। আমরা বিশ্বসভায় একটা আসন পেতে বসার সঙ্গে সঙ্গে পুঁজির কারসাজি শুরু হলো। রাষ্ট্র যখন পুঁজির শাসনে চলে গেল, বৈষম্য একটি অবধারিত শর্ত হিসেবে দেখা দিল।

তারপরও মানুষ দাঁড়িয়েছে, প্রতিরোধ করেছে, হাল ছাড়েনি। কিন্তু সমাজে যদি অনাচার জমতে থাকে, শোষণের নানা পথ তৈরি হয়, তাহলে তো একটা অচলায়তনই দাঁড়িয়ে যায়। এটি ভাঙার জন্য অনেক কালবৈশাখীও যথেষ্ট নয়।

তাই বলে আশা ছেড়ে দেওয়া যায় না। নজরুল তো ছাড়েননি। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু কখনো মনোবল হারাননি। তিনি যখন বলেন সত্য-সাধকের পদাঘাতে সব অটল পাষাণ নিমেষে চূর্ণিত হবে, তখন সেই সত্য-সাধকের ভূমিকাটি আমাদের প্রত্যেককে নিতে হবে। কিন্তু সমাজ কি তৈরি সত্য-সাধকদের জায়গা দিতে, তাদের মেনে নিতে?

২. নতুন বছরের প্রথম দিনে সামনে তাকানোর বিকল্প নেই, কিন্তু সামনে তাকানো অর্থপূর্ণ হয় যদি অতীতটা একবার আমরা ঘুরে আসি। আমরা সবাই চাই, নজরুলের মতো, ‘মিথ্যার সকল সন্ধি, গ্রন্থি বিদীর্ণ হোক।’ কিন্তু এই গ্রন্থি চূর্ণ করার অক্ষমতার জন্য সমাজ এবং রাষ্ট্রকে দোষারোপ করার আগে আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের দিকে তাকাতে হবে। মিথ্যার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন সত্যের। আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কি সত্যকে অকাতরে গ্রহণ করেছি? পরিবারগুলো কি সত্যকে সবার ওপর স্থান দেয়? আমরা ব্যক্তিজীবনে সত্যকে মূল্য দিই, নাকি অসত্যের হাতে নিজেদের সমর্পণ করি? নজরুল যে বলেন, মিথ্যা-অন্যায়ের সঙ্গে রফা হতে পারে না, তা কি আমরা বিশ্বাস করি এবং সে লক্ষ্যে সক্রিয় হই?

রাষ্ট্রের স্খলন নাগরিকেরাই তৈরি করেন, বিশেষ করে আপসকামী নাগরিকেরা। যেকোনো রাষ্ট্রের চরিত্র আধিপত্যবাদী, শোষণকামী। রাষ্ট্র চায় নাগরিকের শর্তহীন বশ্যতা। এবং যত সেই বশ্যতার পরিধি বাড়বে, রাষ্ট্র তত বেপরোয়া হবে। আমরা তো প্রতিবাদহীনভাবে রাষ্ট্রের সবকিছু মেনে নিচ্ছি। বড় বড় অনিয়ম, দুর্নীতি হয়, আমরা প্রতিবাদ করি না, বিত্তশালীদের লোভের শিকার হয় সাধারণ মানুষ, আমরা রা করি না। গ্রামের ক্ষমতাবানদের হাতে মেয়েরা নির্যাতিত হয়, সমাজ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। গত এক মাসের প্রথম আলোর শুধু প্রথম পৃষ্ঠাটি দেখুন—ব্যাংক লোপাট, ইয়াবা ব্যবসা, গুম-অপহরণ, গায়েবি মামলা—সমাজ কি জাগছে এসবের বিরুদ্ধে? সমাজ যদি না জাগে, যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়ায়, তাহলে অন্যায় কি আরও বড় অন্যায় হয়ে দেখা দেবে না? এবং সেই অন্যায়ের গায়ে এমন জোর থাকবে, ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ কেউ তা থেকে রেহাই পাবে না।

৩. নতুন বছরটাতে আমরা বরং নজরুলকে স্মরণ করি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যিনি লড়তেন, যাঁর কণ্ঠে বিপ্লবের আহ্বান শোনা যেত, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে যিনি ছিলেন চির জাগ্রত। তিনি যে বাংলার স্বপ্ন দেখতেন, তা এক স্বয়ংসম্পূর্ণ জনপদের, যেখানে বিত্তের, সামাজিক অবস্থানের এবং শ্রেণির বৈষম্য থাকবে না, যেখানে মানুষ সম্প্রীতির ছায়াতলে এক প্রাণ, এক দেহে লীন হবে, যেখানে তরুণেরা ‘সকল বন্ধ দ্বার’ খুলে দেবে।

আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ, যার জন্ম একাত্তরের হাত ধরে, অনেক অর্জন করতলগত করেছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে এর শরীরে জমা হওয়া সব আবর্জনা ধুয়েমুছে নিতে। এটি সম্ভব যদি আমরা প্রত্যেকে নিজেদের দিকে তাকাই। এবং শুদ্ধির কাজটি শুরু করি।

নতুন বছরটি হোক আর দশটা বছর থেকে পৃথক—এটি হোক এমন এক বছর, যার গল্প যুগ যুগ ধরে বাঙালি শুনবে এবং অনুপ্রাণিত হবে।

সৈয়দমনজুরুলইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ