নদী ও প্রাণ—দুটোই যেন বাঁচে

ফাইল ছবি।

শোনা যাচ্ছে, মরণাপন্ন তিস্তা নদীকে ঘিরে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। চীন সমীক্ষা চালিয়েছে; প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। চীন বাংলাদেশকে এ টাকা ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে বলেও সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আশা করি, যে প্রকল্পই নেওয়া হোক না কেন, তা অন্তত নদী-প্রকৃতি-পরিবেশ-জলবায়ু, নদীতীরবর্তী কৃষি ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে না।

তিস্তা নদী বাংলাদেশ অংশে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার। ভারতের অংশে প্রায় ২০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ অংশে তিস্তার সর্বনাশ হয়েছে দুই দেশের নদী ধ্বংসকারী বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে। এই বড় ও বারোমাসি নদীকে মৌসুমি নদীতে পরিণত করা হয়েছে। ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’ আগামী ১ নভেম্বর তিস্তা নদীর দুধারে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার মানববন্ধনের আয়োজন করছে। এ পর্যন্ত প্রস্তুতিমূলক শতাধিক সভা হয়েছে। আমি এর স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হিসেবে অনেক সমাবেশে উপস্থিত ছিলাম। নদী সুরক্ষা ও নদীতীরবর্তী মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণের দাবিতে এ মানববন্ধন হবে।

সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালি ইউনিয়নে তিস্তা নদী সুরক্ষার দাবিতে একটি সমাবেশে গিয়েছিলাম। সেখানে জয়নুদ্দিনসহ কয়েকজন বৃদ্ধ একটি চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। তাঁরা সবাই চরের ভেতরেই থাকেন। এসেছেন সমাবেশে। তাঁদের সঙ্গে নদী নিয়ে কথা হয়। তাঁদের মতে, তিস্তা নদীর সর্বনাশ করেছে সরকার। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শৈলমারী ইউনিয়নের আলসিয়াপাড়া গ্রামে নদীবিরোধী দুটি কাজ হয়েছে। আমি গত বছর ওই স্থানে সরেজমিনে গিয়েছিলাম। আলসিয়াপাড়ায় আউলিয়াখান নদ তিস্তা নদীতে মিলিত হতো। তখন নদীর একটি নির্দিষ্ট গতিপথ ছিল। জয়নুদ্দিন চাচার ভাষ্য, ‘আউলিয়াখান নদের মুখ বন্ধ করার পরের বছর থাকি নদী দক্ষিণে ভাঙতেছে খুব। ভাঙতে ভাঙতে সোগ শ্যাষ করি দেইল।’

আলসিয়াপাড়ায় তিস্তা থেকে ঘাঘট নদ উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু নদীরক্ষা বাঁধ দেওয়ার নাম করে ঘাঘটের উৎসমুখ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে তিস্তার পানি আর বের হতে পারে না। ঘাঘটও এতে যেমন মারা যাচ্ছে, তেমনি তিস্তার ভাঙনপ্রবণতাও বেড়েছে। নদীরক্ষা বাঁধ দিয়েও তিস্তার ভাঙন কখনো রোধ করা সম্ভব হয়নি। ৪০ থেকে ৪৫ বছর আগে যখন এ নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়, তখন এ নদীর প্রস্থ ছিল প্রায় দুই কিলোমিটার। এখন এ নদীর প্রস্থ স্থানভেদে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটারে পরিণত হয়েছে। বাঁধ দেওয়ার পর নদীতে প্রতিবছর পলি জমা হলে তা অপসারণের প্রয়োজন ছিল। সেই উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়নি। ঘাঘট, মানাস, বাইশাডারাসহ এ নদ–নদীর যত শাখানদী ছিল, সব কটির মুখ বন্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন আর এ নদীর কোনো শাখানদী নেই। শাখানদীগুলো আগে পানি বহন করত। আগের দিনে তিস্তার প্রস্থ এক থেকে দুই কিলোমিটার থাকলেও যে পরিমাণ পানি বহন করতে পারত, এখন প্রস্থে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হয়েও তা আর সম্ভব হচ্ছে না। তিস্তা নদীকে ঘিরে গৃহীত মহাপরিকল্পনায় শাখানদীগুলো বাঁচিয়ে তোলার পদক্ষেপ থাকলে খুব ভালো হবে।

তিস্তা নদী প্রাকৃতিকভাবে আজ করুণ অবস্থায় আসেনি। দিনের পর দিন তিস্তা নদীর ক্ষতিসাধন করতে করতে আজকের অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। এখন এ নদীর কল্যাণে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। তিস্তা তীরবর্তী অসংখ্য মানুষের প্রথম প্রশ্ন, ‘হামার জমির কী হইবে?’ ভাঙনে জমি নদীগর্ভে চলে গেলে তা নদীর অংশ হয়ে ওঠে। এটি নদীপারের মানুষ জানেন না। নদীতে যেহেতু পানি থাকে না, তাই তাঁরা পানি কমে যাওয়ামাত্রই নদীতে বাদাম, কুমড়া, পেঁয়াজ, রসুন, ডালসহ অনেক ফসল উৎপাদন করেন। এ জন্য তাঁদের প্রথম প্রশ্ন, তাঁদের জমি হাতছাড়া হয় কি না। মহাপরিকল্পনায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কথা ভাবতে হবে।

‘ডিফেন্স রিসার্চ ফোরাম’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ‘পাওয়ার চায়না’ নামের একটি কোম্পানির প্রস্তুতকৃত মহাপরিকল্পনাবিষয়ক পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তিস্তা নদীকে প্রস্থে দুই কিলোমিটারে নিয়ে আসা হবে। এতে দুই পাশে জমি উদ্ধার হবে। নদীর দুধারের উদ্ধারকৃত জমিতে শিল্পকারখানা, রিভার ড্রাইভ, অর্থনৈতিক অঞ্চল, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প ও আবাসিক রেস্টুরেন্ট তৈরি করা হবে। ভূমিহীনদের মধ্যেও এ জমি বরাদ্দ করার কথা বলা হয়েছে। তিস্তা নদী খনন করা হবে, নৌ-চ্যানেল থাকবে। ওই ফেসবুকের সূত্রে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংক ও জাইকার কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছিল। তারা সম্মত হয়নি। চীন আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

রিভারাইন পিপল, তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ ও তিস্তা রক্ষা কমিটি কয়েক বছর ধরে তিস্তা নদী সুরক্ষা, বিজ্ঞানসম্মত নদী খনন ও নদী ব্যবস্থাপনার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। নদীর সুরক্ষা হলে যে লক্ষাধিক জেলে-মাঝি তাঁদের কর্ম হারিয়েছেন, তাঁরা কর্মে ফিরতে পারবেন। নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। নদীর ভাঙন কমে আসবে। বর্তমানে বন্যা ও ভাঙনে প্রতিবছর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার কম বলে মনে হয় না। ফলে যে টাকা এখানে ব্যয় হবে, এক বছরেই তার চেয়ে বেশি অর্থমূল্যের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে তীরবর্তী জনপদ।

সতর্কতা: তিস্তা নদীতে প্রচুর পরিমাণ পলি আসে। এই পলি অপসারণের ব্যবস্থা না থাকলে যত গভীর করে নদী খনন করা হোক না কেন, তা ভরাট হবেই। যত উঁচু করে বাঁধ নির্মাণ করা হোক না কেন, নদী রক্ষা হবে না। তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা যেমন জরুরি, তেমনি এ নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি ভারত থেকে পেতেই হবে—এ কথা ভুলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদীরক্ষা-বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

[email protected]