নদী রক্ষার দায়িত্ব আসলে কার

ফাইল ছবি।

ছোট-বড় মিলে দেশে নদীর সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। অথচ নদী দেখভাল করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয় নেই। নদীর অংশবিশেষের সঙ্গে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় যুক্ত। নদী রক্ষায় মন্ত্রণালগুলোর কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ দেখা যায় না। নদীর সামগ্রিক কাজের তদারকির জন্য একক কোনো মন্ত্রণালয় নেই, যার মাধ্যমে সমন্বয়পূর্বক নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনার কাজ করা হবে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কী করছে? এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীগুলোর ক্ষতি করার অন্যতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গুটিকয় কর্মকর্তা ছাড়া অন্য সবাই ফুলেফেঁপে উঠেছেন। কিন্তু নদীর সুরক্ষা নেই। নদী খনন করার নামে তাঁরা দেশের নদীগুলোকে খালে পরিণত করছেন। নদী খননে সিএস নকশাও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এমনও ঘটেছে, নদীর প্রস্থের তিন ভাগের এক ভাগ খনন করছে এবং মাটি নদীর ভেতরেই ফেলছে। আমি সরেজমিনে এ রকম অনেক নদী খনন দেখেছি।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের সব নদী নেই। নামের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছে তারা মূলত পরিবহনকেন্দ্রিক বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে নদীর তদারক করে। সব নদী রক্ষা করার কাজ তাদের নয়। কিছুদিন আগে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী একটি আশার কথা শুনিয়েছেন। দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত নৌ যোগাযোগ চালু করা হবে। এটি খুব ভালোভাবেই সম্ভব। কিন্তু শুধু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কী করবে? নদীকে ঘিরে জলবায়ু পরিবর্তন হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না এবং দূষণে যাতে ক্ষতি না হয়, সেসব দেখার দায়িত্ব এ মন্ত্রণালয়ের। নদীর পানির মান ঠিক আছে কি না, সেটিও পরীক্ষা করে এ মন্ত্রণালয়। তাই বলে নদী রক্ষার কাজ এ মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে করা কঠিন। আর ভূমি মন্ত্রণালয় কি নদীবান্ধব? দেশে ভূমি দেখাশোনা করার দায়িত্ব ভূমি মন্ত্রণালয়ের। নদীর ভাঙন-দূষণ-দখলের মাধ্যমে নদীর যখন সর্বনাশ রচিত হয়, তখন এ মন্ত্রণালয়ের এগিয়ে আসার কথা। কিন্তু এ মন্ত্রণালয় কেন আসবে যখন দেশে পানিসম্পদসহ অন্যান্য নদীসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আছে। দেশের অসংখ্য নদীকে বিল হিসেবে ইজারা দিয়ে নদীর অস্তিত্বই শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। এসব কাজ সংঘটিত হচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। তাহলে নদী রক্ষা তো নয়, বরং নদীর সর্বনাশ হয় এমন কিছু কাজের সঙ্গেই এ মন্ত্রণালয়কে পাওয়া যাচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা নিয়োজিত। স্থানীয়ভাবে জেলার সব ভূমি দেখাশোনার দায়িত্ব এসব কর্মকর্তার। মাঠপর্যায়ের এসব কর্মকর্তা নদীর প্রতি আন্তরিক হলে এবং প্রচলিত আইন প্রয়োগে কঠোর হলে নদীর দখল-দূষণ বন্ধ হতো। কিন্তু তাঁরাও এ কাজে আন্তরিক নন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও যৌথ নদী রক্ষা কমিশন কতটা তৎপর? আমাদের দেশে তালিকাভুক্ত অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা শতাধিক। মিয়ানমারের সঙ্গে তিনটি নদী বাদ দিলে আর সবগুলোই ভারতের সঙ্গে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও যৌথ নদী রক্ষা কমিশন এ নদীগুলোর ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে ভারত থেকে আগে যে পরিমাণ পানি আমরা পেতাম, বিভিন্ন নদীর পানি একতরফা প্রত্যাহারের কারণে সেই পানির প্রাপ্তি আমাদের কমে যাচ্ছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) অনেক নদীকে খাল নাম দিয়ে খননের মাধ্যমে নদীর ক্ষতি করছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তো নদীগুলোর প্রকৃত মাপের চেয়ে ছোট ছোট সেতু নির্মাণ করে। যে নদীতে নৌ চলাচলের পথ ছিল নিচু, সেতু তৈরি করে সেই পথও তারা বন্ধ করেছে। একটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাদের কার্যপরিধিতে ১২টি বিষয়ে শুধু সুপারিশ করার কথা বলা হয়েছে। গত বছর সারা দেশে সব নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে যে রায় দেওয়া হয়েছে, সেখানে এ কমিশনকে নদীর অভিভাবক ঘোষণা করা হয়েছে। আইন পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এ কমিশন নদী রক্ষায় পূর্ণাঙ্গ সক্ষম প্রতিষ্ঠান হতে পারবে না। তবে কমিশন যেভাবে এগোচ্ছে, এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে হয়তো নদীর দেখভাল করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান আমরা পেতে পারি। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নদী নিয়ে তাদের গবেষণা কিংবা নদী সুরক্ষায় তাদের কোনো পরামর্শ কিংবা নির্দেশনা আমরা পাই না।

নদীর সঙ্গে যুক্ত অনেক মন্ত্রণালয়, কিন্তু নদী রক্ষা করার দৃষ্টান্ত কোনো মন্ত্রণালয় করতে পারেনি। যত দিন পর্যন্ত নদী রক্ষা করার জন্য স্বতন্ত্র কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে না, তত দিন নদীগুলোর সরকারি তদারকি আমরা পাব না। তত দিন পর্যন্ত জবাবদিহিও তৈরি হবে না। মনে হবে অনেকেই আছে, বাস্তবে কেউ নেই। নদীপারের মানুষ যদি নদী রক্ষায় মনোযোগ দিত, তাহলে আমাদের নদীগুলোর এত বড় সর্বনাশ হতো না। সরকারিভাবে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরাও ভাবেন সরকারি সম্পদ নষ্ট হলেও যেন তাঁদের কোনো ক্ষতি নেই। মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো সন্তানের মতো চরম অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে আমাদের নদীগুলো।

বাংলাদেশের নদী বাংলাদেশের চালিকা শক্তি। যেভাবে নদীর সর্বনাশ করা হচ্ছে তাতে সব নদীই অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। নদী রক্ষার জন্য একক এমন কোনো মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর কিংবা কমিশন আমরা চাই, যেটি নদী রক্ষায় সার্বক্ষণিক কাজে নিয়োজিত থাকবে। নদীর যেকোনো ক্ষতি হলে তারা জবাবদিহির আওতায় থাকবে। তা না হলে আমাদের নদীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। নদী ভালো না থাকলে আমাদের চালিকা শক্তিও থেমে যাবে।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

[email protected]