নদী রক্ষায় বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে

আজ বিশ্ব নদী দিবস। দখল-দূষণে দেশের নদীগুলো বিপন্নপ্রায়। নদী দেখভালে অনেক মন্ত্রণালয় থাকলেও যথাযথ সমন্বয় ও আইন প্রয়োগ নাই। বুড়িগঙ্গা নদী, লালবাগের শহীদনগর এলাকা
ফাইল ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

দেশের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার মতো একক কোনো মন্ত্রণালয়, কমিশন, অধিদপ্তর নেই। নদী দেখভালে যেসব মন্ত্রণালয় রয়েছে, তাদের মধ্যেও সমন্বয়ের ভীষণ অভাব। নদী সুরক্ষার চেয়েও সর্বনাশ করার মতো অনেক মন্ত্রণালয় আছে। যার যত বেশি দায়িত্ব ছিল, আনুপাতিক হারে তারা তত বেশি সর্বনাশ করছে নদীগুলোর। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার নদী সুরক্ষার তাগিদ দিলেও তা বাস্তবায়নে কোনো তৎপরতা কারও মধ্যে দেখা যায় না।

ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় যদি নদীর জমি ব্যক্তির নামে খারিজ না করত কিংবা খাজনা না নিত, তাহলে সেই জমিতে ব্যক্তি কখনোই মালিকানা দাবি করতে পারত না। কিন্তু গোটা দেশে এটিই হয়ে আসছে। এর দায় ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার এড়াতে পারেন না। নদীর জমি যেহেতু শ্রেণি পরিবর্তনযোগ্য নয়, তাই কখনোই ব্যক্তির নামে নদী লিখে দেওয়ার পথ নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তির নামে নদী লিখে দেওয়ার বড় জালিয়াতি সাবরেজিস্ট্রার করলেও তাঁদের নিয়ে কথা হয় না।

উপজেলা ও জেলায় ভূমি ব্যবস্থাপনা দেখভালের দায়িত্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের। এই দুই কর্মকর্তা উপজেলা ও জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি। কেউ অবৈধভাবে নদী দখল, দূষণ, পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করলে এ দুই কর্মকর্তার তা বন্ধ করার কথা। এমনকি নদী থেকে কেউ অবৈধ বালু উত্তোলন করলেও তা বন্ধ করা তাঁদের দায়িত্ব। ইউএনও ও জেলা প্রশাসকেরা কখনো অনিচ্ছায়, কখনো বহুবিধ কাজের ভারে তা যথাযথভাবে পালন করেন না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ভাঙনের সময়ে নদী রক্ষায় তৎপর হয়। নদী কেন ভাঙে, শুষ্ক মৌসুমে নদী রক্ষার জন্য কী কাজ করা যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে পাউবোর আরও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। পাউবো অনেক নদী খনন করে। খননের সময়ে কোনো নদীর প্রকৃত প্রস্থ মেপে দেখার প্রয়োজন তারা মনে করে না। অনেক নদীকে খাল হিসেবেও খনন করে তারা।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন নদীর নাম-পরিচয় মুছে ফেলার জন্য নদীর পাড়ে সাইনবোর্ড দেয় খাল হিসেবে। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একই কাজ করে থাকে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের এমন কাজ সারা দেশেই রয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও নদীর সর্বনাশ করায় লিপ্ত। মৎস্য বিভাগ নদী খননের জন্য একসঙ্গে অনেক টাকা বরাদ্দ পায় না। পুকুর খননের জন্য তাদের টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে জন্য নদী কেটে তারা ছোট ছোট পুকুর তৈরি করে। কুড়িগ্রামে সাত বোন নামে একটি নদ আছে। সেই নদে গত বছর কয়েকটি পুকুর কেটেছে মৎস্য বিভাগ। এ রকম অনেক বিলে ও নদীতে তারা পুকুর কাটে। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারাও নদী কেটে পুকুর বানান। রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার বাইশাডারা নামে একটি নদী আছে। সেই নদীটি চলতি বছরে স্থানীয় সরকার বিভাগ খনন করে পুকুর বানাচ্ছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সব নদীতে কাজ করে না। তাদের কাজও সামগ্রিকভাবে নদীবান্ধব নয়। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কোনো নদীর ওপর দিয়ে যখন সড়ক তথা সেতু নির্মাণ করে, তখন নদীর প্রকৃত মাপের চেয়ে অনেক ছোট করে সেতু নির্মাণ করে। আর অবৈধ দখলদারেরা সেতুর মাপ ধরে নদীর প্রস্থ চিহ্নিত করে।

নদীর সর্বনাশকারীরা কোনো নদীর সর্বনাশ গোপনে করেন না। প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় এত বড় সর্বনাশ হওয়ার পরও কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। যদি কোনো সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, সাবরেজিস্ট্রার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, প্রকৌশলী, মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা, অবৈধ দখলদারদের শাস্তির বিধান হতো, তাহলে অনেকেই সাবধান হতেন। সেটি না হওয়ায় সবাই এই অপরাধ করেই চলেছেন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ১২টি ধারায় শুধু সুপারিশ করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। ২০১৯ সালে যে রায়ে বাংলাদেশের নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সেই রায়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবক ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনের মাধ্যমে শক্তিশালী করারও নির্দেশনা দেন মহামান্য আদালত। কিন্তু সেই রায় এখনো পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। নদীবিষয়ক যেকোনো কাজে কমিশনের কাছে অনুমোদন নেওয়ার কথা রায়ে বলা হলেও সরকারের কোনো সংস্থাই এ কাজ করে না।

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী রক্ষা কমিশন অনেকটা অকার্যকর। বছরে চারবার সভা হওয়ার কথা থাকলেও চার বছরে একটি হয় কি না, সন্দেহ। বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীগুলোর সমস্যা সমাধানে এই কমিশন ভূমিকা রাখতে পারত। অভিন্ন নদীর স্বার্থ রক্ষায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের দেশের অনেক নদী দূষিত হচ্ছে। দূষিত নদী পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেন না।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা নদী দখল করে থাকেন। এমনকি নদীর ইজারাও গ্রহণ করেন স্থানীয় রাজনীতিকেরা। স্থানীয় প্রশাসক, রাজনীতিক, ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা অনেক সময় জোটবদ্ধ হয়েও নদীর সর্বনাশ করেন। বিশেষ করে কোথাও নদী উদ্ধারে সাধারণ মানুষ এগিয়ে এলে দলমত-নির্বিশেষে অবৈধ দখল বজায় রাখার স্বার্থে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হন।

নদীর সর্বনাশকারীরা কোনো নদীর সর্বনাশ গোপনে করেন না। প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় এত বড় সর্বনাশ হওয়ার পরও কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। যদি কোনো সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, সাবরেজিস্ট্রার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, প্রকৌশলী, মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা, অবৈধ দখলদারদের শাস্তির বিধান হতো, তাহলে অনেকেই সাবধান হতেন। সেটি না হওয়ায় সবাই এই অপরাধ করেই চলেছেন। নদী সুরক্ষায় এমন অবহেলা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। নদী-প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে মানুষ ভালো থাকতে পারে না, পারবে না। চরম বিপদে পড়ে একদিন সব নদী রক্ষা করতেই হবে। সেই চেষ্টা যত বিলম্বে হবে, ততই সর্বনাশ।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

[email protected]