নদীকে কেন খাল বলা হচ্ছে

‘হামরা তো আলাইকুমারীক নদী হিসাবে জানি। সরকার কেম্বা খাল নেকি থুইচে।’ একই কথা রংপুরের আলাইকুমারী নদীর পাশে হাজার মানুষের। তাদের মনে বড় প্রশ্ন, নদীকে কেন খাল বলা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ছয় খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থে এ নদীর পরিচিতি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী। পরিচিতি সংখ্যা ৭। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটার। তবে উৎস স্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়ন। সরেজমিনে দেখা যায়, এর উৎস আদি রংপুর মাহিগঞ্জের ইছামতী নদী থেকে। নদীটি ঘাঘট নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে নদীটি বিলুপ্ত করার কাজ চলছে।

নদীটিকে কেন খাল বলা হচ্ছে, এ প্রশ্ন আমিও তুলেছিলাম রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চলতি বছরের শুরুতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদারের উপস্থিতিতে নদীসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের একটি সভায়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) একজন প্রকৌশলী জানালেন, পীরগাছা উপজেলার একজন ইউএনও নাকি আলাইকুমারীকে ‘খাল বা নদী’ উল্লেখ করে এর সংস্কারের কথা বলেছিলেন। তাই এটিকে তাঁরা খাল হিসেবে আমলে নিয়েছেন। সম্পূরক প্রশ্ন না করলেও উপস্থিত সবার বুঝতে না পারার কথা নয় যে বাস্তবে নদীকে খাল বলা যায় না।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি নদীর সর্বনাশ কত সহজে হয়, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আলাইকুমারী নদী। বলা যায় একটি নদীর টুঁটি টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা। নদীটি যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। গত বছর বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ দেশের নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছেন। সেই বিবেচনায় একটি জীবন্ত সত্তাকে আধমরা করা হয়েছে।

নদীটি কোথাও আলাইকুড়ি, কোথাও আলাইকুমারী নামে পরিচিত। নদীটির দুই পারের মানুষ এর পরিচিতি নদী হিসেবে জানলেও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের কাছে এর পরিচিতি খাল হিসেবে। নদীটিকে খাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে তারা খনন করার অধিকার লাভ করতে পারে। সরকারি এ সংস্থার নদী খননের অধিকার নেই। তাই সরকারের কাছে এ নদীটিকে খাল হিসেবে উল্লেখ করে বিএডিসি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খনন করেছে। এমনভাবে নদীটি খনন করেছে, যাতে এটাকে দেখতে অন্তত একটি খালের মতোই দেখা যায়। নদীটির প্রস্থ সিএস নকশায় যা আছে, তা আমলে নেওয়া হয়নি।

এমনকি বিদ্যমান যে নদী আছে, তারও প্রস্থ মানা হয়নি। নদীটি এখনো অনেক স্থানে প্রস্থে অনেকখানি। কিন্তু নদী প্রস্থে যত বড়ই হোক না কেন, তারা নির্দিষ্ট অংশই খনন করেছে। দেখা গেছে, কোথাও কোথাও নদীর তিন ভাগের এক ভাগ খনন করেছে। যে অংশে খনন করেছে, সেখানে খননকৃত মাটি আবার নদীর ভেতরেই ফেলেছে। এ বাস্তবতা দেশের নতুন খনন করা অনেক নদীতেই দেখা গেছে। অনেক স্থানে এ নদীটিকে খাল উল্লেখ করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে।

সম্প্রতি এ নদীর পাশ দিয়ে সরেজমিনে নদীটির অবস্থা দেখার চেষ্টা করি। পীরগাছার খড়খড়ির ঘাটে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি। সেখানে কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি একই কথা জানালেন, বিএডিসি সাইনবোর্ড ঝোলানোর আগে তাঁরা কোনো দিন শোনেননি এটি খাল। নদীটি খনন করার সময় সীমানা চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে নদীটি প্রস্থে সরকারিভাবে কত বড়, তা–ও জানা যাচ্ছে না।

নদীটির বেশ কয়েকটি স্থানে দেখলাম নদীর প্রকৃত প্রস্থের চার ভাগের এক ভাগ ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক নদীতে দেখেছি নদীর চেয়ে সেতু ছোট হলে দখলদারেরা ওই মাটিকে নদীর মাপ ধরে নিয়ে নদীর দুই পাড় দখল করে নেন। নদীর ওপর এমন ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণ করা উচিত নয়, যা নদীর প্রকৃত প্রস্থের চেয়ে কম হয়।

পীরগাছা উপজেলায় বড়দরগা নামক একটি বাজার আছে। এই বাজারের পাশ দিয়ে নদীটি বয়ে গেছে। বাজারের ময়লা–আবর্জনা ফেলার একটি জায়গায় পরিণত হয়েছে নদীটি। স্থানীয় ব্যক্তিরা একটি স্কুল দেখিয়ে দিয়ে অভিযোগের সুরে বললেন, ওই স্কুলের একটি লম্বা ঘর নদীর জমিতে গড়ে উঠেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান নদীপারেই বলেছিলেন, যঁারা এ কাজ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

এ নদীর ওপর দখলদার রয়েছেন প্রচুর। অনেক স্থানে নদীর ভেতর পুকুর বানানো হয়েছে। নদীটির সামান্য প্রবাহ বজায় রেখে নদীর বড় অংশই এখন দখলে। তালুক কল্যাণী নামক গ্রামে এ রকম বেশ কয়েকটি পুকুর আছে নদীর ওপর। কোথাও কোথাও লাফ দিয়ে এখন নদীটি পার হওয়া সম্ভব। বড়দরগা বাজারের পাশেই জাহাঙ্গীর নামের একজন পশুচিকিৎসক ঘর তোলার জন্য কংক্রিটের খুঁটি দিয়েছেন। নদীর পারে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি আমার জমিতি ঘর করছি।’ নদীর জমি কীভাবে তাঁর হয়, এ কথার কোনো সদুত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকেন।

এ নদীতে একসময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। বিহারি গ্রামে নুর মোহাম্মদ এবং কামাল হোসেন এ নদীতে বিচিত্র মাছ থাকার কথা বলছিলেন। প্রচুর বোয়াল ও শোল মাছ ছিল এ নদীতে। বোয়াল, পাবদাসহ অনেক মাছই এখন আর এ নদীতে পাওয়া যায় না।

নদীপারে অনেকের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, তাঁরা বিএডিসির খননপ্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তুষ্ট। কোনো মাপজোখ নেই কিন্তু খনন হচ্ছে। নদীর পাড় অনেকেই দখল করে নিচ্ছেন। কিন্তু কেউ কেন মুখ খোলেন না, এমন কথার জবাবে বোঝা যাচ্ছিল তাঁরা নিজেদের
জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চান না। তাঁরা কেউ বুঝতে চান না নদীর পারের মানুষ না জাগলে নদী বাঁচানো যাবে না। তাঁরা মনে করেন, ক্ষমতাবানেরা নদী দখল করে থাকেন। তাঁদের নিষেধ করে কেউ শত্রুতা বাড়াতে চান না।

তাহলে কি আলাইকুমারী নদী তার অধিকার ফিরে পাবে না? ১৭ আগস্ট ছিল নদী অধিকার দিবস। ২০১৪ সালের এই দিনে জাতিসংঘে নদী রক্ষায় আইন প্রণীত হয়। আমরা চাই আলাইকুমারীসহ দেশের সব নদী ফিরে পাক তার অধিকার।


তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক