নদীখেকোদের শাস্তি হয় না কেন

ছবি প্রথম আলো

দেশের সবচেয়ে স্বাধীন অপরাধী নদীখেকোরা। নদীখেকোরা জানেন নদী দখল করার জন্য কোনো শাস্তি তাঁদের পেতে হবে না। খুব বেশি হলে, সরকারি টাকা খরচ করে, ডজন ডজন সরকারি কর্মচারী মিলে দখলটুকু শুধু উচ্ছেদ করা হবে। এর চেয়ে আর বেশি কিছু নয়। শাস্তি হয় না বলেই নদীর ক্ষতি দিনের পর দিন বাড়ছে।

কিছু কিছু আইনের প্রয়োগ করেও যে দেশে দুর্নীতি আটকানো যাচ্ছে না, সেই দেশে এমন অপরাধ করার পথ খোলা রাখা হয়েছে, যার কোনো শাস্তি নেই বললেই চলে। গত বছর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের প্রায় অর্ধ লাখ দখলদারের তালিকা প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি দখল করে আছেন এসব অসাধু ব্যক্তি। তারপরও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। রাষ্ট্র কি তবে অপরাধীর কাছে পরাজিত না আশ্রয়দাতা? নাকি নদী দখল-দূষণ করা কিংবা এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা নগণ্য অপরাধ?

ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হক ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদীর ৫৪ একর জমি দখল করেছেন বলে নদী কমিশন সূত্রে জানা যাচ্ছে। ২৭ নভেম্বর প্রথম আলোয় এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। নদীর এক ইঞ্চি জমি দখল করলেও তো তাঁর শাস্তি হওয়ার কথা। সেখানে একরের পর একর জমি দখল হয়ে যা কীভাবে?  
দেশের সব প্রচলিত আইনের এক রকম প্রয়োগ আর নদীসংক্রান্ত অপরাধীদের বেলায় আইনের প্রয়োগ ভিন্নতর। ধরা যাক, কেউ সড়কের পাশে সরকারিভাবে লাগানো এক হাজার গাছ কেটে নিয়ে গেছেন। এর শাস্তি কি হবে যে তাঁর বাড়ি থেকে শুধু গাছগুলো ফিরিয়ে আনা? তা হবে না। তাঁর নামে থানায় বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ হবে, পুলিশ গ্রেপ্তার করবে। গাছ কাটার অভিযোগে শাস্তি হবে।

শাস্তির বিধান থাকায় সড়কের গাছ খুব গোপনে চুরি করতে হয়। ধরা পড়লেই শাস্তি। নদী দখলের মতো গাছ দখলও শাস্তিবিহীন থাকলে দেশে কোনো সড়কের পাশে গাছ থাকত না। তেমনি নদীখেকোদের শাস্তির ব্যবস্থা থাকলে দখলদারও খুঁজে পাওয়া যেত না। গাছ কাটলে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়, তার চেয়ে ঢের ক্ষতি হয় নদী দখল করলে। গাছ কাটলে অর্থের কিংবা গণমানুষের যে ভোগান্তি হয় না, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয় নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ করলে। তারপরও নদী ধ্বংসকারীরা শাস্তির আওতায় নেই।

ধরা যাক, ‘ক’ ব্যক্তি রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে তার ক্ষতি করল। তখনই তার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। আবার ধরা যাক, ওই ‘ক’ ব্যক্তি নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে নদী দখলে নিয়ে বাড়ি করল কিংবা মাছ চাষ করল। এতে শুধু একজনের নয়, অনেকের হাজার হাজার একর জমির ফসলের ক্ষতি হলো। নদীর গুরুতর ক্ষতিও সাধিত হলো। এত কিছুর পরও তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। এটা একটা দ্বৈতনীতির আইন প্রয়োগের বাস্তবতা।

সরকার যদি নদীখেকোদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় তাহলে নদী সহজেই দখলমুক্ত হতে পারে। যারা নদী দখল করে আছেন, এ রকম ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনলেই অন্য দখলদারেরা দখল ছাড়ার পথ সন্ধান করবেন। আইন আছে, এমনকি কোর্টের রায় আছে দখলদারদের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার নদী উদ্ধারের ঘোষণাও দিয়েছেন। তারপরও নদী দখলের কারণে লাখ লাখ একর জমির ফসল ক্ষতি হচ্ছে। কোটি কোটি মানুষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

যেসব সরকারি কর্তাব্যক্তি নদীকে ব্যক্তির নামে লিখে দেন তাঁদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। যাঁরা নদীকে বিল কিংবা জলমহাল নাম দিয়ে লিজ দেন, তাঁরাও নদীর অনেক বড় শত্রু। তাঁদের বিরুদ্ধেও শাস্তির সংস্কৃতি চালু করতে হবে।

আর সামান্য কিছু মানুষ নদী দখল করে কোটি মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করবে, এটি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। নদী থেকে দখল উচ্ছেদের সব ব্যয় নির্বাহ করতে হবে দখলদারদের। শুধু তা–ই নয় দখলের কারণে নদীর এবং মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিও সংশ্লিষ্ট দখলদারদের থেকে আদায় করতে হবে। যাঁরা সরকারের জমি দখল করে আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতেই হবে। একজন দখলদারের কারাবাস হলে অন্য দখলদারেরা শঙ্কিত হবেন।

নদীর দখলদারেরা সমাজে বুক উঁচিয়ে দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করছেন। তাঁরাই যেন সমাজের শাসক। আমরা যাঁরা নদী নিয়ে কাজ করি, তাঁদেরই শুনতে হয় নানান হুমকি। অধঃপতন কতটা হলে দখলদারেরা লজ্জাবোধ, অপমানবোধ, অপরাধবোধ ভুলে সমাজে চলাফেরা করেন, সেটাই এখন দৃশ্যমান। দখলদারদের নামের তালিকা বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। এ কাজটিও করা হয় না। দখলদারেরা যেহেতু অনেক বড় অনৈতিক কাজ করছেন তাই তাঁদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তুলতে হবে। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা না গেলে তারা অপরাধ কর্ম থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখবে না।

শুধু বেসরকারিভাবে নদীর সর্বনাশ হয়, তা নয়। নদীর সর্বনাশকারী সরকারি ব্যক্তিদের জন্যও নির্দেশনা এবং নদীর ক্ষতিকর প্রকল্প গ্রহণ করলে শাস্তির সংস্কৃতি চালু করতে হবে। যেসব সরকারি কর্তাব্যক্তি নদীকে ব্যক্তির নামে লিখে দেন তাঁদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। যাঁরা নদীকে বিল কিংবা জলমহাল নাম দিয়ে লিজ দেন, তাঁরাও নদীর অনেক বড় শত্রু। তাঁদের বিরুদ্ধেও শাস্তির সংস্কৃতি চালু করতে হবে। নদীর প্রয়োজনের চেয়ে যাঁরা অনেক ছোট সেতু বা কালভার্ট কিংবা নদীর ওপর সেতু ছাড়া আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করেন, তাঁদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।


তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক