নর্ডিক-বাংলাদেশ যৌথ যাত্রা এগিয়ে নিতে চাই

উইনি এস্ট্রাপ পিটারসেন, এসপেন রিক্টার-স্ভেনসেন, আলেক্সান্দ্রা বার্গ ভন লিন্ডে

এ বছর সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্ক—এ তিন নর্ডিক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর বন্ধুত্বের ৫০ বছর পূর্তি। ১৯৭১ সালে নর্ডিক দেশগুলো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের দিকে গভীর নজর রাখছিল এবং দেরি না করেই তারা ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকে এই যৌথ যাত্রা আমাদের বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে নির্ভরযোগ্য অংশীদার ও বন্ধু হিসেবে; নর্ডিক দেশগুলো সব সময়ই বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পাশে ছিল।

স্বাধীনতাপ্রাপ্তির একদম শুরুর দিকে এবং প্রথম দশকগুলোতে বাংলাদেশ নর্ডিক দেশগুলো থেকে বড় অঙ্কের সাহায্য ও সহায়তা পেয়েছে। এ সহযোগিতা প্রথমে মানবিক সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে শুরু হয় এবং পরে তা উন্নয়ন সহযোগিতায় রূপান্তরিত হয়, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি ও বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলেছে। সেই থেকে আমাদের সহযোগিতা বহু এবং বিবিধ খাতে ব্যাপ্তি লাভ করেছে। উন্নয়ন সহযোগিতা আমাদের সম্পর্কের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ; এ সহযোগিতা পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশে জোরালো ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রেখেছে।

বিগত দশকগুলোতে নর্ডিক-বাংলাদেশ সম্পর্ক পরিণত ও আরও বিস্তৃত হয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা এ অংশীদারত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চাই। বহু বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের দৃঢ় ব্যবস্থা নর্ডিক দেশগুলোর নজরে এসেছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিরোধ সবার আগে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে একটি উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সবার আগে রয়েছে। নর্ডিক দেশগুলো প্রতিরোধব্যবস্থা যেমন বন্যার পূর্বাভাস, সাইক্লোনকালীন আশ্রয়স্থল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহায়তা প্রদান করতে পেরে গর্ব বোধ করে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে বাংলাদেশের বেঁচে থাকার প্রশংসা করি এবং আমরা বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া ও তার সঙ্গে মানিয়ে চলার প্রচেষ্টার পাশে থাকব। একই সঙ্গে আমরা কার্বন নির্গমন হ্রাস ও পরিবেশবান্ধব সবুজ প্রযুক্তি, যা জলবায়ুবান্ধব চৌকস সমাধান আনতে পারে, তাতে রূপান্তরিত করতে সহায়তা দিয়ে যাব।

পানি, জ্বালানি শক্তি, যোগাযোগ ও ডিজিটালাইজেশন, স্মার্ট সিটি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা—এসব খাতে পরিবেশবান্ধব সবুজ প্রযুক্তিতে রূপান্তর নর্ডিক দেশগুলোর অগ্রাধিকারে থাকবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে কার্বন নির্গমন ও জ্বালানি শক্তি ব্যবহার হ্রাস এবং প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারের সমন্বয়ের জন্য আমরা নর্ডিক দেশগুলো সর্বজনবিদিত। নর্ডিক কোম্পানিগুলো পরীক্ষিত পরিবেশবান্ধব সমাধান নিয়ে আসতে পারবে। আমরা শিক্ষণীয় বিষয়গুলো এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে জানাতে চাই। নর্ডিক-বাংলাদেশ সহযোগিতার সম্ভাব্য অন্য ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক সম্পদ ও ব্লু ইকোনমি। বেশ কিছু খাতে আমরা আরও অধিক মাত্রায় পারস্পরিক অংশীদারত্বের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখতে পাই। যেমন উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে উপকূলবর্তী ও সামুদ্রিক প্রাকৃতিক সম্পদের পরিবেশবান্ধব উত্তোলন, জাহাজ নির্মাণ, শিপিং এবং বন্দর সুবিধাগুলো উন্নত করা। এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও নর্ডিক দেশগুলো উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতে পারস্পরিক সহযোগিতা বিস্তৃত করতে পারে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান নর্ডিক দেশগুলোর সমাজের অন্যতম ভিত্তি এবং এগুলো আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সব ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। আমরা এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী যে গণতন্ত্রই একটি টেকসই সমাজের জন্য সবচেয়ে উন্নত ভিত। আইনের শাসনে চলা গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও সমতাভিত্তিক সমাজ সবার সামর্থ্যের পূর্ণ বিকাশের সুযোগ প্রদান করে।

বর্তমানে ১০০টির বেশি নর্ডিক কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে। এটি একটি চলমান ও পরিবর্তনশীল নর্ডিক-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রমাণ। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ ও নর্ডিক দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নিরন্তর বৃদ্ধি ঘটেছে এবং এখন আমরা সার্বিক বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধিতে, উভয় পক্ষেরই, আগের তুলনায় অনেক বেশি উৎসাহ লক্ষ করছি। নর্ডিক দেশগুলোর বেশ কিছু বিনিয়োগ ও আমদানি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যকে ছাড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের ক্ষমতায়নে অবদান রেখেছে (যেমন: গ্রামীণফোন, এইচঅ্যান্ডএম, আরলা)।

নারী-পুরুষ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের ওপর আমরা নর্ডিকরা অনেক গুরুত্ব আরোপ করি, এটি এমন একটি অগ্রাধিকার, যে বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের মিল রয়েছে। আমরা দেখেছি যে তৈরি পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক নারী কাজ করেন, এ খাতে বড় নর্ডিক কোম্পানিগুলোর সক্রিয়তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের কাজে বিনিয়োগ শুধু একটি সঠিক কাজই নয়, একই সঙ্গে এটি একটি চৌকস ও লাভজনক কাজ। নারীর অধিকার সুরক্ষাসহ নারী-পুরুষ সমতা, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধ, জীবিকা ও শিক্ষার সুযোগ এবং নারীর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির গুণগত মান উন্নয়নের পথ বের করার জন্য বহু দশক ধরে নর্ডিক দেশগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে নারী-পুরুষ সমতার উন্নতিতে আমাদের এ প্রচেষ্টা সুফল বয়ে এনেছে। সামাজিক কুপ্রথা, ক্ষমতার কাঠামো এবং লিঙ্গবৈষম্য ও লিঙ্গভিত্তিক ভেদাভেদ নিরসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় আমাদের রয়েছে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান নর্ডিক দেশগুলোর সমাজের অন্যতম ভিত্তি এবং এগুলো আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সব ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। আমরা এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী যে গণতন্ত্রই একটি টেকসই সমাজের জন্য সবচেয়ে উন্নত ভিত। আইনের শাসনে চলা গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও সমতাভিত্তিক সমাজ সবার সামর্থ্যের পূর্ণ বিকাশের সুযোগ প্রদান করে। অক্ষুণ্ন মানবাধিকার গণতন্ত্রের পরিপূরক এবং তা ন্যায়ভিত্তিক ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনে গণতন্ত্রকে শক্তি জোগায়। গণতন্ত্রের বিকাশ ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাব।

আরও পড়ুন

নর্ডিক রাষ্ট্রগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট কিন্তু তারা বহুপক্ষীয়তা ও বৈশ্বিক সংহতির একনিষ্ঠ সমর্থক। এ আশাবাদের বিষয়ে আমরা ও বাংলাদেশ একমত। এ কারণেই নর্ডিক দেশগুলো রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মৌলিক প্রয়োজন ও অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য প্রদান ছাড়াও নর্ডিক দেশগুলো যথাসময়ে রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক, নিরাপদ ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের প্রয়াসের প্রতি কূটনৈতিক সমর্থন জানিয়ে আসছে। নর্ডিক-বাংলাদেশ সহযোগিতা বহুপক্ষীয়তা, টেকসই উন্নয়ন এবং যৌথভাবে ২০৩০-এর লক্ষ্যগুলোকে অর্জন করতে আমাদের অনুরূপ আশার বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার প্রতিফলন করে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশ টেকসই উন্নয়নের এই তিন মৌলিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে নর্ডিক দেশগুলো ভবিষ্যতেও সহযোগিতা করার মতো অবস্থায় আছে।

বিগত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে আগামী ৫০ বছর এবং তারও বেশি সময় নর্ডিক দেশগুলো ও বাংলাদেশের এ যৌথ যাত্রা আনন্দের সঙ্গে অব্যাহত রাখতে চাই আমরা।

উইনি এস্ট্রাপ পিটারসেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত

এসপেন রিক্টার-স্ভেনসেন বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত

আলেক্সান্দ্রা বার্গ ভন লিন্ডে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত