নাগরিক সমাজ নিয়ে অভিযোগ কতটা সঠিক?

একটি ফোনালাপ, গ্রেপ্তার ও মামলার সূত্র ধরে রাজনৈতিক সভায়, টিভির টক শো ও সংবাদপত্রে কেউ কেউ ‘নাগরিক সমাজকে’ অভিযুক্ত করছেন। নাগরিক সমাজের সমালোচনাও করছেন। এ অভিযোগ-সমালোচনা ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সমালোচকেরা বুঝে না–বুঝে এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজের সমালোচনা করছেন।
প্রথমে পরিষ্কার করা দরকার, ‘নাগরিক সমাজ’ বলতে আমরা কাদের বোঝাই। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। আমাদের মত হলো, যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী বা সদস্য নন, যাঁরা সরকারি কোনো চাকরি করেন না, তাঁরা সবাই নাগরিক সমাজের অংশ। যাঁরা রাজনৈতিক দলের কর্মী বা সদস্য, তাঁদের নিজস্ব ফোরামে নিজের মতামত দিতে পারেন। অন্য নাগরিকদের সেই সুযোগ নেই। তাই তাঁরা বিভিন্ন নামে নাগরিক ফোরাম গঠন করেন, যে ফোরামে নাগরিকেরা সরকার, রাজনৈতিক দল, সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তাঁদের মতামত প্রকাশ করেন। তাঁরা সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের ওপর নজরদারি করেন। নাগরিকদের কাছে এটা সরকারের একধরনের জবাবদিহি। তাঁরা কোনো দল, নেতা বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থে কোনো কথা বলেন না। তাঁরা শুধু নাগরিকদের স্বার্থের কথা বলেন। দুই বড় রাজনৈতিক দল প্রভাবিত কয়েকটি নাগরিক ফোরামও সমাজে রয়েছে। তারা বিশেষ কোনো দল বা নেতার স্বার্থে কথা বলে, কিন্তু নিজেরা সরাসরি রাজনীতি করে না। এ ধরনের নাগরিক ফোরাম ছদ্মবেশী। এরা প্রকৃত নির্দল নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করে না।
‘নাগরিক ঐক্য’ একটি রাজনৈতিক দল। তাদের কর্মকাণ্ড পুরোটাই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এ উদ্যোগের সঙ্গে কোনো নাগরিক ফোরামের সম্পর্ক কখনো ছিল না। ‘নাগরিক ঐক্য’ নির্বাচন করবে। বিভিন্ন ‘নাগরিক ফোরাম’ কখনো নির্বাচন করার স্বপ্ন দেখেনি। ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নও দেখেনি। এটা তাদের কাজও নয়। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট দূর করা, পেট্রলবোমা ও সন্ত্রাসের অবসান এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি জাতীয় সনদ তৈরির প্রস্তাব নিয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক সম্প্রতি একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁরা মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে বিভিন্ন দলের সঙ্গে একটা আলোচনার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ প্রস্তাব সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এটা একটা সাময়িক উদ্যোগ। অনেকে বলতে পারেন, ‘কিছু রাজনৈতিক দলও সংলাপের প্রস্তাব করেছে। কাজেই তারাও নাগরিক সমাজ।’ খুব সরল ব্যাখ্যা। সিপিবি, বাসদ, জেএসডি, গণফোরাম—এসব দলও সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছে। তাহলে এরাও নাগরিক সমাজ? এভাবে কোনো বিষয়কে ব্যাখ্যা করা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘সুজন’সহ কয়েকটি নাগরিক ফোরাম বছরব্যাপী নানা ইস্যুতে তাদের মতামত ও সুপারিশ দিয়ে থাকে। শুধু বর্তমান সংকটের সময় দিচ্ছে এমন নয়।
নাগরিক সমাজের (বিভিন্ন ফোরামে বিভক্ত) নানা বক্তব্য ও দাবি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। সেটা দোষের কিছু নয়। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দুর্নীতির অবসান চায়। নাগরিক সমাজও দুর্নীতির অবসান চায়। তাহলে তাদেরকে ‘একজোট’ বলতে হবে? এ রকম আরও বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে।
নাগরিক সমাজের কোনো ব্যক্তি যদি কোনো ‘ষড়যন্ত্রের’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে প্রমাণিতও হয়, তবু তাঁর জন্য নাগরিক সমাজ সামগ্রিকভাবে দায়ী হতে পারে না। ওই বিশেষ ব্যক্তি দায়ী হতে পারেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কোনো কোনো নেতা নানা অভিযোগে অভিযুক্ত এবং অনেকে আদালতের রায়ে দণ্ডও পেয়েছেন। শুধু ওই ব্যক্তিরা দণ্ড পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ দণ্ড পায়নি। গুরুতর অভিযোগে সরকার তাদের এক নেতাকে মন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেছে, দল তাঁর প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করেছে। কোনো ব্যক্তির অপরাধ সমগ্র দলের অপরাধ হতে পারে না।
অনেক সমালোচক বলেন, নাগরিক সমাজ নাশকতার সমর্থক। তাঁদের উদ্দেশে বলব, সুজন ও অন্য কয়েকটি নাগরিক ফোরামের সেমিনার, মানববন্ধন, বিবৃতি ও টক শোতে তাঁদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে তারপর মন্তব্য করুন। নাগরিক সমাজ কঠোর ভাষায় পেট্রলবোমা–সন্ত্রাসের নিন্দা করেছে এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি করেছে। একই সঙ্গে নাগরিক সমাজ আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডেরও নিন্দা করেছে। নাগরিক সমাজ বর্তমান পেট্রলবোমা–সন্ত্রাস বন্ধ হওয়ার পর দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট দূর করার জন্য সব দলকে নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে সংলাপ করার অনুরোধ করেছে। এ আবেদন ইতিবাচক পদক্ষেপ।
অনেকে টিভির টক শো ও এর আলোচকদের সমালোচনা শুরু করেছেন। এটাও আরেকটা বিভ্রান্তি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, নাগরিক ঐক্য, সিপিবি, জাতীয় পার্টি, বাসদ এবং আরও নানা দলের নেতা টক শোতে অংশ নিয়ে থাকেন। টক শোতে রাজনীতিবিদেরা তাঁদের দলের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিয়ে থাকেন। অনেক নির্দল বুদ্ধিজীবীও তাঁদের বিবেচনামতো বক্তব্য দেন। অনেক দলীয় বুদ্ধিজীবী বিশেষ দলের পক্ষে বক্তব্য দেন। দর্শক এসব আলোচনা উপভোগ করেন। উপভোগ না করলে টিভি কর্তৃপক্ষ এসব অনুষ্ঠান বছরের পর বছর প্রচার করত না। অনেকের মতে, টিভির টক শো একটা মিনি পার্লামেন্ট। আমাদের মূল পার্লামেন্টে তো বিতর্ক হয় না। সবই একতরফা প্রশংসা বা একতরফা সমালোচনা। দর্শক টিভির টক শোতে দেশের নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক বিতর্ক দেখতে পান।
অনেকে টক শোতেও ‘ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ পাচ্ছেন। কিন্তু টক শো তো প্রকাশ্য বিষয়। গোপনে রেকর্ড করারও দরকার নেই। সবার সামনে সবাই কথা বলছেন। এখানে ষড়যন্ত্র কোথায় ও কীভাবে হয়, তা আমরা বুঝতে পারি না। অনেক সমালোচক বলেন, ‘নাগরিক সমাজের নেতারা নাকি অসাংবিধানিক পথে সরকার পরিবর্তনে ইন্ধন জোগাচ্ছেন।’ এটাও একটা অপপ্রচার। প্রথমত, নাগরিক সমাজ সরকার পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখে না। সরকার পরিবর্তন হয় ভোটের মাধ্যমে। নাগরিক সমাজ নিরপেক্ষ, সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে সব সময় কথা বলে আসছে। নাগরিক সমাজ সঠিক পদ্ধতির জন্য কথা বলে। ভোটে কে জিতবে, কে ক্ষমতায় যাবে—সেই লড়াইয়ে নাগরিক সমাজ জড়িত নয়। ভোটের ময়দানে নাগরিক সমাজের প্রত্যেকে একজন ভোটার মাত্র। নাগরিক সমাজের সদস্যরা বিভিন্ন দল বা প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকেন। কোনো দলের প্রতীক নিয়ে নাগরিক সমাজে কখনো আলোচনা হয় না। সেটা পুরোপুরি রাজনৈতিক দলের ব্যাপার। অসাংবিধানিক পথে সরকার পরিবর্তন অতীতে হয়েছে সরকার ও রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার জন্য। কারণ, সরকারের নানা দুর্বলতা ও ভুল-ভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে অতীতে অসাংবিধানিক শক্তি অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করেছে। নাগরিক সমাজ এত ক্ষুদ্র শক্তি যে তাদের পক্ষে কোনো অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় বসানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া বর্তমানে সংবিধানে যে ধারা যুক্ত হয়েছে, তাতে এ রকম আশঙ্কা অমূলক। প্রত্যেকে নিজের জীবনকে ভালোবাসে। যারা এ ধরনের চক্রান্তে লিপ্ত, তারা দিবাস্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তা নয়। নাগরিক সমাজ বাংলাদেশে এখনো খুব ক্ষুদ্র একটি শক্তি (সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য)। কারণ, নির্দল নাগরিকেরা সংগঠিত নন। তাঁরা সুসংগঠিত ও সোচ্চার হলে কোনো সরকারই স্বৈরাচারী হতে পারত না। নাগরিক সমাজ দেশের সংকটকালে দেশের স্বার্থে কথা বলে। তা কখনো সরকারের, কখনো বিরোধী দলের বিপক্ষে যেতে পারে। তাই বলব, তথ্য-প্রমাণ ছাড়া নাগরিক সমাজ সম্পর্কে ঢালাও সমালোচনা ঠিক নয়।
যত সমালোচনাই করা হোক না কেন, নাগরিক সমাজ দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে ন্যায্য কথা বলে যাবে। ক্ষমতায় কোন দল আছে, সেটা তাদের বিবেচ্য নয়। আজ বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও নাগরিক সমাজের ভূমিকা একই হতো। তারা কোনো দলের প্রতিনিধিত্ব করে না। কোনো নেতার কৃপাপ্রার্থীও নয়। নাগরিক সামজের এই স্বাধীন ও সাহসী ভূমিকার ওপরই নির্ভর করছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী