নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংশোধন করতে হবে

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত এখন উত্তপ্ত। সেখানে ক্ষোভ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। বিজেপিশাসিত মেঘালয় ও মিজোরামের পর নাগাল্যান্ডও এই বিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি এই অঞ্চলের রাজনৈতিক কেন্দ্র গুয়াহাটিতে একটি বৈঠকে মেঘালয় ও মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী, নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি ও ত্রিপুরার বিজেপি সরকারের একজন মিত্র ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা এই বিলকে ‘সাম্প্রদায়িক বিল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা এই বৈঠকের আয়োজন করেন।

এই বিলের মূল কথা হচ্ছে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে যে অমুসলিম মানুষেরা ভারতে এসেছেন, শুধু সেই সব শরণার্থীকেই ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। বাকিদের দেওয়া হবে না। মজার বিষয় হচ্ছে এই নাগরিকত্ব বিল লোকসভায় পাস হওয়ার সময় যে দল ওয়াকআউট করে, সেই কংগ্রেস প্রথমে এ ব্যাপারে নীরব ছিল। এখন কংগ্রেস বলছে, তারা তাদের এমপিদের বলবে রাজ্যসভায় এই বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে।

এই বিল নিয়ে আসাম এবং অন্যান্য স্থানে নানা সময়ে বিক্ষোভ সমাবেশে ১৯৮৫ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির কথা বারবার এসেছে। আসাম চুক্তি নামে ভারত সরকার ও অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তির মূল কথা ছিল, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের আগ পর্যন্ত যারা বাংলাদেশ থেকে এ অঞ্চলে এসেছে, কেবল তাদেরই ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ওই চুক্তির লক্ষ্য ছিল ভারতে অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে একটি সহিংস আন্দোলনকে শান্ত করা। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত চলা ওই আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।

বিজেপি যখন কেন্দ্র ও আসাম রাজ্যের ক্ষমতায় এল, তখন আসাম চুক্তিকে হালনাগাদ করতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) তালিকা নিয়ে দ্রুত কাজ শুরু করে, যাতে বিপুলসংখ্যক অ-ভারতীয়র অস্তিত্ব স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। গত বছরের জুলাই মাসে আসাম রাজ্য সরকার জাতীয় নাগরিকপঞ্জির তালিকা প্রকাশ করার পর দেখা গেল, এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে প্রায় ৪০ লাখ বাঙালি। তখন ভারতজুড়ে আসাম সরকারের এই উদ্যোগ ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের একটি দল এ ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি লেখে। ৩২ লাখ মানুষ তাদের এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়ার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে মামলা করলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এনআরসি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের এ সমস্যা সমাধানের জন্য আরও সময় দেন। কিন্তু তখন দিল্লির সরকারি কর্মকর্তারা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে থাকেন যে কেন্দ্র এটা করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং বিলটির ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

এভাবে মুসলমানদের ভারতের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ভারতীয় সংবিধানের বিরোধী; যেখানে বলা হয়েছে ভারতের যেকোনো অংশে সব নাগরিকের সমতা ও সমান সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। ভারতের নাগরিকত্ব আইন ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করতে পারে না। যদি এ ধরনের কোনো আইন করা হয়, সেটি হবে তাদের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। আর এ দেশে সংখ্যালঘু নাগরিকদের সংখ্যা সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে তার কি আদৌ কোনো সত্যতা আছে? আসামে যেভাবে বেশিসংখ্যক মানুষের অভিবাসনের কথা বলা হয়, সেটা সত্য নয়। আসামের বিজেপি নেতাদের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের পর থেকে লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসী ভারতে এসেছে এবং তারা আর ফেরত যায়নি। বিজেপি নেতাদের এই দাবি ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর হিসাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাদের মতে, এই সংখ্যা ৩১ হাজার ৩১৩ জন। তার মানে হচ্ছে অভিবাসীর সংখ্যাটা স্রেফ অনুমান।

ভারতের জনক মহাত্মা গান্ধীর দূত গোপীনাথ বরদলই (পরে যিনি স্বাধীন ভারতে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন) ১৯৪৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর বলেছিলেন, ‘কেউ আসামকে দিয়ে কোনো কিছু করাতে পারবে না যা সে চায় না। এটা একটি স্বায়ত্তশাসিত ইউনিট হিসেবে স্বাধীনভাবে থাকবে।’ ব্রিটিশ কেবিনেট মিশন আসামে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির শাসনের প্রস্তাব দেওয়ার প্রেক্ষাপটে বরদলই এ কথা বলেন।

আসামের বর্তমান শাসকেরা আরও এক কাঠি এগিয়ে। তারা বাঙালি, বিশেষ করে মুসলিম বাঙালিদের সহ্যই করতে পারছে না। এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যতে তা সবার জন্য বিপদই ডেকে আনবে। তাই দিল্লির এখন উচিত এই নাগরিকত্ব বিল সংশোধন করা।

দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
সঞ্জয় হাজারিকা, কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের আন্তর্জাতিক পরিচালক