নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিয়ে যেসব ফ্যাক্ট না জানলেই নয়

আমি নারায়ণগঞ্জ শহরের একজন স্থায়ী বাসিন্দা। পৌরসভা থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশনের ২০১৬ সালের মেয়র নির্বাচন খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন সংবাদকর্মী হিসেবেও গত ১৮ দিন বিভিন্ন প্রার্থীর প্রচার দলের সঙ্গে থেকে পুরো নগরের চিত্র দেখার সুযোগ হয়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতাসহ একটি ধারণা তৈরি হয়েছে এ নির্বাচন নিয়ে।

১৩ জানুয়ারি একটি দৈনিক পত্রিকা নাসিক নির্বাচনের ১০ ফ্যাক্টর নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আমি সেই বিষয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। প্রকাশিত খবরের ১ নম্বর ফ্যাক্টরে এসেছে ওসমান পরিবারের অনুসারীদের ভোট। যদি ২০১১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত শামীম ওসমানের প্রাপ্ত ভোটকে ওসমান পরিবারের হিসেবে ধরি, তাহলে ৭৮ হাজার ভোটের অধিকারী তাঁরা। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, গত ১০ বছরে তাঁদের ভোট কমেছে ছাড়া বাড়েনি। বিষয়টি পরিষ্কার করতে চাই যে এই ভোটব্যাংকের বড়জোর ৫ শতাংশ ভোট এবার নৌকায় পড়বে। ১৫-২০ শতাংশ ভোট দানে বিরত থাকবে আর দুঃখজনকভাবে বাকি ভোট হাতি মার্কা পাবে।

দ্বিতীয় ফ্যাক্টর হচ্ছে, নারীদের ভোট। সেলিনা হায়াৎ আইভীর সবচেয়ে শক্তির দিকটি নষ্ট করতে সম্ভব সব চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও অর্ধেক, তথা আড়াই লক্ষাধিক নারী ভোটের কমপক্ষে ৯০ শতাংশ আইভির পক্ষেই যাবে। নৌকা নয়, আইভী পাবেন এই একচেটিয়া ভোট।

তারপর এসেছে অঞ্চলভিত্তিক লাখখানেক ভোট। যাঁর অর্ধেকের বেশি আবার মুন্সিগঞ্জের ভোটার। একটি অকাট্য সত্যি হলো, আইভী সারা দেশেই বড় একটি অংশের পছন্দের একজন। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর যোগ্যতা দেশজুড়েই সমাদৃত। এই ভোটের বেশিটাই আইভীর পক্ষে যাবে। কেননা মুন্সিগঞ্জে আপাত নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় মানুষেরাই নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা হয়েছেন।

অনেকেরই ধারণা, হেফাজত ও কওমিপন্থী ভোটাররা একচেটিয়া হাতির পক্ষে, মানে তৈমুর আলম খন্দকারকে ভোট দেবেন। আসলে এই ভোট চার ভাগে ভাগ হবে। খেলাফত মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন ভালো একটি অংশ ভোট পাবেন তাঁদের থেকে। আর সংখ্যালঘুদের ভোট বরাবরের মতো নৌকাতেই বেশি পড়বে। তবে জামায়াতের ভোট তৈমুর পাবেন। বিএনপির ভোটব্যাংক থেকেও বড় একটি অংশ আইভীর নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠে সব সময়।

ইতিহাস বলে, সারা বছর দলীয় বিভাজন ক্রিয়াশীল থাকলেও, ভোটের দিন দক্ষিণের মানুষ দল চেনেন না, প্রার্থী চেনেন। আর অধিকাংশ মিডিয়া কেবল আওয়ামী লীগের কোন্দল নিয়ে ব্যস্ত ছিল। যদি প্রশ্ন করি, জাকির খান, রাজীব বা গিয়াস কামালদের অনুসারীদের কটি ভোট পাবেন তৈমুর? গিয়াস ও কামালপুত্র কাউন্সিলর পদে লড়ছেন। আইভী তাঁর প্রচারে সাবেক এমপিপুত্রদের এলাকায় গেলে বিপুল অভ্যর্থনা পান।

এটি স্বয়ং তৈমুরও জানেন, নির্বাচনে ফলাফল কী হবে? দুঃখজনকভাবে আওয়ামী লীগের একটি অংশ কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে নিয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকারের উচ্চ মহলের কঠোর নির্দেশনা আছে স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের। তাই ব্যর্থ হচ্ছে সব অপচেষ্টা। ১৩ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে নানক ও বাহাউদ্দিন নাছিমের বৈঠক নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুললেও বিশ্বস্ত সূত্রের খবর হলো, তাঁরা গিয়েছিলেন সতর্কবার্তা দিতে, যেন ভোট প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। প্রচারের ১৮ দিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সিটির অলিগলি চষে বেরিয়েছেন তাঁরা।

দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্লেষণ করেছেন, যোগ-বিয়োগের অঙ্ক কষে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন, ভোটের ফল নিজেদের অনুকূলেই আসবে। তাই এখন তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। পশ্চিমা বিশ্বের শ্যন দৃষ্টি এই নির্বাচনের দিকে। ওরা যেন কোনো বিরূপ মন্তব্যের সুযোগ না পায়, সেটাই সরকারের লক্ষ্য।
এবার বিগত সময়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখি। ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায়, শামীম ওসমানসহ আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী পলাতক, মাত্র ১৭ দিন আগে নিউজিল্যান্ড থেকে এনে আইভীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়। বিএনপির প্রার্থী হন নুরুল ইসলাম সরদার। এবারের মতো ওই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু ভোট দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ পৌরবাসীই। প্রতিকূল সেই সময়ে আইভী ১৬ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। ২০১১ সালের ৫ মে নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদম রসুল পৌরসভা মিলিয়ে গঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। সে বছরের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় প্রথম নাসিক নির্বাচন। বহুল আলোচিত সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত শামীম ওসমানকে এক লাখ ছয় হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র হন স্বতন্ত্র প্রার্থী আইভী।

এরপর ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নাসিকের দ্বিতীয় নির্বাচন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আইভী বিএনপির আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেনকে হারিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র পদে আসীন হন। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরার কারণ হলো, ওই তিন নির্বাচনেই পরাজিত প্রার্থী নারায়ণগঞ্জের অর্ধশত বছরের পুরোনো উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বিভাজনের রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন। পরাজিত তিনজনই উত্তর অংশের বাসিন্দা ছিলেন। আরও পেছনে গেলে, উত্তরের কেউ জয়ী হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের পৌর বা সিটিতে, এমন একটি দৃষ্টান্তও পাবেন না।

এবার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এবারের নির্বাচনে তৈমুর আলম খন্দকারের প্রচার টিমের সঙ্গে তিন দিন, সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে সাত দিন, মুফতি মাসুম বিল্লাহ ও এ বি এম সিরাজুল মামুনের সঙ্গে এক দিন করে ছিলাম পেশাগত দায়িত্ব পালনে। মাসখানেক নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডেই একাধিকবার গিয়েছি। অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে ছোট্ট করে বলছি, আইভীর সঙ্গে দুটি শক্তি ক্রিয়াশীল, যেখানে বাকিরা একটি নিয়ে ভোটের মাঠে নেমেছেন। তৈমুর হবেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আইভী যদি আওয়ামী লীগকে পুঁজি করে ভোট করতেন, তাহলে তৈমুর এমনকি জিতেও যেতেন।

নৌকার সঙ্গে আইভীর নিজস্বতা মিলেছে বলেই ব্যবধানটি স্পষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটি পূর্বাভাস না দিলেই নয়, তা হলো গত নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের মুফতি মাসুম বিল্লাহ ১৯ হাজার ভোট পেয়েছিলেন, এবার তিন গুণ বেশি পেলেও আমি অবাক হব না।

নাসিক নির্বাচন নিয়ে এটি আমার নিজস্ব মতামত। নিজেই অপেক্ষায় রইলাম। ফলাফল ঘোষিত হলেই না বুঝতে পারব কতটা সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছি।

রাসেল আদিত্য সাংবাদিক