নারীকে মানসিক নির্যাতন করাও যে আইনবিরুদ্ধ তা কি আমরা জানি?

‘সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!’
ছোটবেলা থেকে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের এই কবিতা আমরা কেবল পড়েছিই, নিজেদের মধ্যে আয়ত্ত করতে পারিনি। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী, অথচ এই নারীকেই প্রতিনিয়ত পারিবারিক, সামাজিক অধিকার তো বটেই, স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যেতে হচ্ছে। কেন যেন অধিকাংশের কাছে একজন নারীর পরিচয় কেবল শারীরিক অবয়বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন নাই। সমাজের কতিপয় মানুষের মানসিকতার জন্য না ঘরে, না ঘরের বাইরে, বিশ্বের কোথাও নারী নিরাপদ নয়।

দক্ষিণ আমেরিকার ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনার্ভা মিরাবেল নামে তিন বোনকে হত্যা করা হয়। নারীর ওপর এই নির্যাতন সারা বিশ্বে, বিশেষ করে নারী সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯৮১ সালে ২৫ নভেম্বর দক্ষিণ আমেরিকার নারীদের এক সম্মেলনে এই দিনটিকে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময় ১৯৯৩ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে এই দিনটি স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়, পাশাপাশি ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আজ ২৫ নভেম্বর—   ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’।

দুনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে, আধুনিক থেকে আরও আধুনিক হচ্ছে। কিন্তু নারীদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নমূলক আচরণ বেড়েই চলেছে। নারী সহিংসতা কী, তা আসলে বোঝা সহজ নয়। কারণ, এখনো মানুষ সহিংসতা কী, তা জানে না। সহিংসতার বিভিন্ন ধরন নিয়ে আলোচনা করা অপেক্ষাকৃত সহজ হলেও এর সংজ্ঞা দেওয়া অসম্ভব। আমাদের দেশে অনেকেই জানেন না যে, মানসিক নির্যাতনও সহিংসতার সংজ্ঞায় পড়ে এবং দেশের আইন অনুযায়ী এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নারীর প্রতি নানা রকম সহিংসতার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত; কিন্তু নারীর প্রতি নির্যাতন যতক্ষণ না দৃশ্যমান হয়, ততক্ষণ সেটাকে সহিংসতা ধরা হয় না।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক সারা দেশের ৪ হাজার ৮০০ নারী-পুরুষের মধ্যে একটি জরিপ চালায়। সেখানে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ মানুষ নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে কেবল মারধরকেই বোঝে। ৭ শতাংশ মার দেখানোর ভয়কেও সহিংসতা মনে করে। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এর ধারা ৩(খ)-তে মানসিক নির্যাতন কীভাবে হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভীতি প্রদর্শন বা এমন কিছু বলা, যা দ্বারা একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা হলে তা সহিংসতার সংজ্ঞায় পড়বে। এ ছাড়া কাউকে হয়রানি করা, তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা, স্বাভাবিক চলাচল, যোগাযোগ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশের ওপর হস্তক্ষেপ করাও মানসিক নির্যাতন হিসেবে গণ্য করা হবে। এর মানে যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো, কোনো নারী সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিংবা তাঁর অগোচরে তাঁকে নিয়ে কটূক্তি করাটাও সহিংসতা এবং তা রীতিমতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

প্রথম আলো-প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপ অনুসারে, ৭১ শতাংশ মানুষ ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তিকর ও অপমানজনক মন্তব্যের মাধ্যমে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হন ব্যবহারকারীরা, যার ৪৫ শতাংশের বেশি নারী ।

নারীর প্রতি এই সহিংসতাই এক ভয়ংকর মাত্রায় পৌঁছেছে অনলাইনে বা ভার্চ্যুয়ালজগতে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী এই সহিংসতার সংখ্যা বেড়ে গেছে। ২০২০ সালের ২১ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম আলো ও বেসরকারি সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ একটি জরিপ চালায়। সেই জরিপে উঠে আসে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭৯ শতাংশের বেশি কখনো না কখনো অনলাইনে হয়রানি বা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এই ৭৯ শতাংশের ৫৩ শতাংশই নারী। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে নারীদের শরীর, পোশাক, ছবি নিয়ে অশালীন মন্তব্য, নির্যাতনের হুমকিসহ নানান রকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী-পুরুষেরা।

প্রথম আলো-প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপ অনুসারে, ৭১ শতাংশ মানুষ ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তিকর ও অপমানজনক মন্তব্যের মাধ্যমে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হন ব্যবহারকারীরা, যার ৪৫ শতাংশের বেশি নারী । সাইবার হয়রানি ভুক্তভোগীদের জীবনে কী প্রভাব পড়েছে, সে সম্পর্কে একাধিক মত প্রকাশ করেছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীরা। ৭১ শতাংশ জানিয়েছেন ঘটনাগুলো তাঁদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করেছে। মানসিক চাপের মধ্যে পড়া ব্যক্তিদের ৪৭ শতাংশ নারী। ৫২ শতাংশের বেশি জানিয়েছেন, এসব হয়রানি তাঁদের স্বাধীনভাবে চলাচল ও মত প্রকাশে বাধা তৈরি করেছে। এর মধ্যে নারী ৩২ শতাংশ। নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ৩৬ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৫ শতাংশ। সামাজিকভাবে হেয় ও বিব্রত হয়েছেন ৩০ শতাংশ; তাঁদের মধ্যে নারী ১৭ শতাংশ। এ ছাড়া ২৪ শতাংশ আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগেছেন, ১৯ শতাংশ নিপীড়িত হচ্ছেন—এমন অনুভব করেছেন বলে জানিয়েছেন। ১৪ শতাংশেরও বেশি হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়ে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার বন্ধই করে দিয়েছেন।

পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতিচর্চা সবকিছুতে পরিবর্তন আনতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, সচেতনতা বাড়াতে হবে। লিঙ্গবৈষম্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যদি বদলাতে হয়, তবে অল্প বয়স থেকেই ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিতে হবে।

অথচ, দৃশ্যটা যেমন এমন হওয়ার কথা ছিল না, দৃশ্যটা এমনই থাকবে এমনটাও আমরা চাই না। যুগের পর যুগ বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমাতে নারীকে খাটো করে উপস্থাপন করা হয়, যা নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও রূঢ় আচরণ বাড়িয়েছে বিভিন্ন সময় (প্রথম আলো-প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপ ফলাফল)। নারীর প্রতি সহিংসতা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং বিচারহীনতারই একটি রূপ। আমরা একটু চাইলেই বদলে যেতে পারে এই দৃশ্যপট। পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতিচর্চা সবকিছুতে পরিবর্তন আনতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, সচেতনতা বাড়াতে হবে। লিঙ্গবৈষম্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যদি বদলাতে হয়, তবে অল্প বয়স থেকেই ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিতে হবে।

শিক্ষা উপকরণ এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন ছেলে বা মেয়ে কেউই কোনো লিঙ্গের প্রতি পক্ষপাত নিয়ে বড় হতে না পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি, বাবা-মায়ের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের মধ্যে এমন সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, যা দেখে সন্তানেরা বাবা-মায়ের সমঅধিকার, সমান দায়িত্ব, পারস্পরিক সম্মান এই বিষয়গুলো দেখে বড় হয়। সব পেশার সব মানুষের নিজ নিজ অবস্থান থেকে পেশাগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনের প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে।

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক, একসঙ্গে আমরা সবাই মিলে যেন এই ভয়ংকর দিনগুলো ভালোতে বদলে দিতে পারি। পার্থিব জগতের সঙ্গে সঙ্গে অপার্থিব জগৎটাও আমাদের সব মেয়েদের জন্য নিরাপদ হয়ে উঠুক।

মাহবুবা সুলতানা সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাস্ট