নারীজাগরণের পুরোধা বন্ধু

কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ
কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ

বিপ্লবী মানুষদের জীবন শিল্পী-সাহিত্যিকদের জীবনের মতো ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় না। কারণ, বিপ্লব-সংগ্রাম-রাজনীতি-আন্দোলন এসব মানুষের ব্যক্তিজীবনকে সংক্ষিপ্ত ও গৌণ করে রাখে। যদিও পারিবারিক অনুকূলতা না থাকলে তাঁদের সংগ্রামের পথ অমসৃণ হয়, তবু ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন’ বলে যাঁরা বেরিয়ে পড়েন, তাঁদের স্বজনদের অনেক পীড়া সহ্য করতে হয়। বিপ্লবীরা দলে দলে জন্মান না। যুগের প্রয়োজনে কালেভদ্রে উদয় হন। কিন্তু তাঁদের আদর্শ, অবদান, ত্যাগ, স্বপ্ন যুগের পর যুগ অনুপ্রাণিত করে যায়। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের চেতনা যাঁরা ধারণ করেন, তাঁদের শুদ্ধ চিন্তায় এখনো মানুষের কল্যাণ আন্দোলিত হয়। গতকাল ছিল তাঁর প্রয়াণ দিবস।

কমরেড ফরহাদের জন্মদিন-মৃত্যুদিনে আলোচনা বা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়। আন্তরিক আগ্রহ নিয়ে তাঁর সম্পর্কে জানতে চাই। যেহেতু আমার লেখার মূল উপজীব্য নারী বা লৈঙ্গিক সমতা, সেহেতু কমরেড ফরহাদের কর্মসূচিতে নারীর উন্নয়নের দিকটা কতখানি গুরুত্ব পেয়েছিল তার অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তাঁর এই অনুন্মোচিত দিকটা জানতে চাওয়ার আগ্রহ বোধ করেছি। বলা বাহুল্য, কমিউনিজমের চেতনার মূলেই রয়েছে বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। সেখানে নারী-পুরুষের অধিকারের সমতা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সেটা কতখানি প্রযোজ্য আমাদের মতো অনগ্রসর সমাজে? এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর মধ্যে? পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের অসম আচরণের বিরুদ্ধে বৈষম্যহীনতার প্রতিভূ সমাজতন্ত্রীরা আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিলেন। নারীরা সঙ্গে থাকলেও তাঁদের চাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী নারীর জন্য আলাদা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। দৃপ্ত পদচারণে এগিয়ে এলেন মালেকা বেগম, মমতা হেনা, মনিরা খান, ফরিদা আক্তার, ফওজিয়া মোসলেম, আয়শা খানম, ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্নার মতো আরও সাহসী নারী।

স্মৃতিচারণায় ফওজিয়া মোসলেম বলছিলেন, ’৬৮–এর গণ–আন্দোলনে ‘অগ্নিকন্যা’ মতিয়া চৌধুরী গ্রেপ্তার হলে নেত্রী মালেকা বেগম মতিয়া চৌধুরীর মুক্তির দাবি জানিয়ে নারীদের একটি বিবৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। ফওজিয়া মোসলেম বললেন, ‘তিনি বিবৃতির খসড়া এবং তাতে স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে—এমন সব নারীর একটি তালিকা আমার হাতে তুলে দিলেন। পূর্ব ধারণা থেকে বুঝতে অসুবিধা হলো না পরিকল্পনাটা কীভাবে, কোথা থেকে আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। বিশেষ করে ওই তালিকায় এমন কতগুলো নাম ছিল, যাঁদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির যোগাযোগ ছিল। কাজেই বুঝতে পারলাম যেসব ছাত্রী শিক্ষাজীবন শেষ করছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবন সম্বন্ধেও পার্টি চিন্তাভাবনা করছে। আর এই সব ছাত্রীর সঙ্গে পার্টির যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলেন কমরেড ফরহাদ। সুতরাং সমগ্র বিষয়টি তাঁর নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানেই যে চলছে, সেটা অপ্রকাশ্য থাকলেও আমরা বুঝতে পারলাম।’

কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ বিশ্বাস করতেন নারীর অন্তর্নিহিত শক্তিতে। নারীরা নিজে সংগঠিত না হলে পুরুষতন্ত্রের আরোপিত মূল্যবোধ থেকে নিজেদের বের করে আনা সহজ হবে না। কিন্তু একটা সংগঠন দাঁড় করাতে গেলে তার গঠনতন্ত্র, অবকাঠামো, ঘোষণাপত্র ইত্যাদির প্রয়োজন সবার আগে। কমিউনিস্ট পার্টি ও কমরেড ফরহাদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় মহিলা সংগ্রাম কমিটি পরবর্তীকালে ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ নামে পরিচিতি পেল। এ রকম কথাও প্রচলিত আছে যে মহিলা পরিষদ নামক ছাতাটি ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, ছাতাটি মেলেছিলেন মালেকা বেগম আর এর নির্মাণটি কমরেড ফরহাদের। কমরেড ফরহাদ তাঁর বিপ্লবের মাধ্যমে ঘুণে ধরা সমাজটা পাল্টাতে চেয়েছিলেন। মফস্বলে বেড়ে ওঠা সাধারণ পরিবারের একটি ছেলে সমাজের নানা অনাচার দেখে কৈশোরেই বেদনাহত হয়েছিলেন বলে একটি শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভেবেছিলেন সমাজতন্ত্রই গড়তে পারে একটি মানবিক পৃথিবী। মানবিকতার দীক্ষা যিনি গ্রহণ করেন, তাঁর কাছে নারী-পুরুষের সমাজসৃষ্ট বৈষম্য অর্থহীন। তাই ১৯৭৮ সালে যখন মহিলা পরিষদ সালেহা হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করে, তখন কমরেড ফরহাদ সেই প্রতিবাদে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিলেন। কবি সুফিয়া কামালের আহ্বানে গঠিত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠনে পার্টির কর্মীদের নির্দেশও দিয়েছিলেন। ন্যায্য দাবি আদায়ে সোচ্চার আজকের সংগ্রামী নারীদের পেছনেও একজন কমরেড ফরহাদের মতো বন্ধু ও পুরোধা ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি।

কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ একজন স্বনির্মিত মানুষ। অবহেলিত, সুযোগবঞ্চিত মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। কিন্তু ছিলেন ক্ষণজন্মা বিপ্লবী পুরুষ। বঙ্গবন্ধুর নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় বঙ্গবন্ধু তাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘বঙ্গভবনের জামাই’। কাজে ও সততায় মুগ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর কমরেড ফরহাদকে সংগঠনটির প্রশিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন। কমরেড আমৃত্যু কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন কিন্তু নিজের ভাগ্যোন্নয়নের কথা কোনো দিন ভাবেননি। জেল-জুলুম-অত্যাচার-ফেরারি জীবন নিয়ে ৫০ না পেরোনো সামান্য জীবন কী অসামান্য করে রেখে গেছেন! 

নিজের অদম্য আগ্রহ থেকেই কমরেড ফরহাদ সম্পর্কে পড়েছি, শুনেছি। তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, সেই সব স্বজনহারা প্রবীণ এখনো তাঁকে স্মরণ করে আবেগে চোখ মোছেন। তাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। কাউকে না জানিয়ে খুব গোপনে যেসব মানুষ ও তাঁদের পরিবারকে তিনি আর্থিক সহায়তাসহ মানবিক বন্ধুতা দিয়েছিলেন, তাঁরা সেদিনও যেন কাঁচা ক্ষত নিয়ে কথা বলছিলেন। সেদিন শরতের ভোরে শিউলিগাছের তলায় তলায় অনেক শিউলি ফুল। চারপাশ গন্ধে ম–ম। শিউলি তো ক্ষণজন্মাই। কমরেডও কি তবে শিউলি মানুষ?

আমরা যারা এই বনভূমিতে বসে আছি/ তাদের সামনে ঝরে পড়ছে শিউলির বোঁটা/ শিউলি মানে শৈশব, শিউলি মানে প্রথম প্রেমের গন্ধ/ শিউলি মানে নেতিয়ে পড়া দুপুর/ তারপর বিষণ্ন বিকেল, কোজাগরি রাত/ কিন্তু শিউলি মরে না স্মৃতির ভেজা দেয়াল থেকে/ যে দেয়াল গেঁথে গেছে সুকোমল রাজমিস্ত্রি, কিশোর স্বপ্নভুক/ আজ শিউলির গায়ে লেখা থাকে নামাবলি/ নাম জপো নাম জপো/ ভালোবাসার নাম, মানুষের নাম/ যে মানুষ ক্ষণপ্রভা শিউলির মতো শুধু স্মৃতি হয়ে থাকে আমাদের মুমূর্ষু শীতের ভোরে।/ শীত ফুরায়, সুঘ্রাণ ফুরায় না।

উম্মে মুসলিমা, কবি ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]