নারীর কাজি হতে পারা না পারা

অন্য ধর্মীয় রীতিনীতিগুলোর তুলনায় মুসলিম আইনে বিয়ে সম্পন্ন করার বিষয়টি খুবই সাধারণ। মুসলিমদের ক্ষেত্রে একটি বৈধ বিয়ের জন্য শুধু প্রয়োজন বর-কনের উভয়ের সম্মতি এবং প্রয়োজনীয় সাক্ষীর উপস্থিতি। যদিও লোকাচার অনুযায়ী, বর-কনের সম্মতি গ্রহণের আগে সাধারণত কোরআন পাঠ হয় এবং আরও কিছু সামাজিক আচার মানা হয়।

মুসলিম বিয়ে নিবন্ধনের নিয়মটি কিন্তু মুসলিম আইনের প্রচলিত কোনো ধর্মীয় রীতি নয়। এটি ১৯৬১ সালে পাকিস্তান আমলে করা মুসলিম ফ্যামিলি ল অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আনা একটি সংস্কারধর্মী বিধান। যেহেতু দলিল ছাড়া বিয়ে প্রমাণ করার বিষয়টি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, সে কারণেই বিয়ে নিবন্ধন এবং কাবিননামা সম্পন্ন করার বিধান করা হয়েছিল এ আইনে। এখন পর্যন্ত এ আইনকে উপমহাদেশে মুসলিম ধর্মীয় আইনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বলা হয়। যদিও বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশনের কথা বলা হয়েছে এবং রেজিস্ট্রেশনের বিধান না মানলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, তারপরও যেহেতু মুসলিম বিয়ে মুসলিম আইন অনুযায়ী হওয়ার কথা, তাই রেজিস্ট্রেশন না করলে সেই বিয়েকে কিন্তু আইনটিতে অবৈধ বলা হয়নি।

আমাদের সংবিধান সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা আর আইনের চোখে সমতা নিশ্চিত করছে, নিশ্চয়তা দিচ্ছে নারী-পুরুষভেদে বৈষম্য না করার। বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে, আর প্রগতিশীল ধ্যানধারণাকে এগিয়ে নিতে উচ্চ আদালত আমাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেবেন, ন্যায়বিচারের গুরুদায়িত্ব যাঁর ওপর, তাঁর কাছ থেকে আমাদের আশা এতটুকুই

১৯৬১ সালের আইনটি বাংলাদেশে এখনো প্রযোজ্য হলেও এর ধারা ৫, যা কিনা বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশনের কথা বলেছে, সেই ধারাটিকে ১৯৭৪ সালের মুসলিম ম্যারেজেস অ্যান্ড ডিভোর্সেস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে বাতিল করা হয়। ১৯৭৪-এর এই আইনে একইভাবে বিয়ে এবং তালাক রেজিস্ট্রেশনের বিধান রাখা হয়। রেজিস্ট্রেশনের কাজ সম্পন্ন করার জন্য এলাকাভিত্তিক নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের বিধান রাখা হয়, আমরা যাঁদের ‘কাজি’ বলে জানি। আর নিকাহ রেজিস্ট্রার অফিসকে বলি ‘কাজি অফিস’।

মোটাদাগে, একটি হলো মুসলিমদের ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়। আরেকটি হলো পরবর্তী সময়ে সংস্কারের মাধ্যমে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন–সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় আইনের বিষয়। অর্থাৎ বিয়ে পড়ানো আর বিয়ে রেজিস্ট্রেশন—দুটি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু আমরা অনেক সময় দুটো বিষয়কে এক করে দেখি। তার পেছনে কারণ হলো, আইন অনুযায়ী মাদ্রাসার আলিম সার্টিফিকেটধারী একজন ব্যক্তি নিকাহ রেজিস্ট্রার হয়ে থাকেন এবং সাধারণত তিনিই কোরআন পাঠসহ বিয়ে পড়ানোর অন্যান্য আচার সম্পন্ন করে থাকেন।

এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি সিদ্ধান্ত বেশ আলোচিত হচ্ছে, যেখানে একজন নারী নিকাহ রেজিস্ট্রারপ্রার্থীকে চূড়ান্ত প্যানেলে বাছাই করার পর পুরো প্যানেলটিই বাতিল করা হয়েছিল আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এবং সে সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে একজন প্যানেলভুক্ত আবেদনকারী একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন উচ্চ আদালতে। মন্ত্রণালয়ের এ চিঠিতে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল, বাছাইকৃত প্যানেলের তিনজনই ছিলেন নারী আবেদনকারী আর বাংলাদেশের বাস্তবতায় নারীদের পক্ষে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। হাইকোর্ট ডিভিশনের এ সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, নিকাহ রেজিস্ট্রারের মূল কাজ হলো ‘বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা এবং মুসলিম বিয়ের তথ্য নিবন্ধন করা’।

তবে ১৯৭৪ সালের আইনটির প্রারম্ভিকেই কিন্তু বলা হয়েছে, আইনটি করা হয়েছে শুধু মুসলিম বিয়ে এবং তালাক নিবন্ধন করার জন্যই। সেখানে একজন নিকাহ রেজিস্ট্রারের বিয়ে পড়ানোসংক্রান্ত রীতিনীতি পালনের বিষয়টি তাঁর আইনগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা আর বিয়ের রেজিস্ট্রেশন যে এক বিষয় নয়, তার ইঙ্গিত কিন্তু আইনটির ধারা ৫ এবং ২০০৯ সালের আইনের বিধিমালাতেই রয়েছে। আইন এবং বিধি বলছে, যদি বিয়ে পড়ানোর কাজটি নিকাহ রেজিস্ট্রার নিজেই করে থাকেন, তবে তাঁকে বিয়েটি অবশ্যই তৎক্ষণাৎ নিবন্ধন করিয়ে নিতে হবে; কিন্তু তিনি ছাড়া যদি অন্য কেউ বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন, তবে তাঁকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই রেজিস্ট্রারের কাছে এসে বিয়েটি নিবন্ধন করিয়ে নিতে হবে। অর্থাৎ নিকাহ রেজিস্ট্রার নিজে কোনো বিয়ের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা অন্য কেউ সম্পন্ন করতে পারেন এবং তা করাও হয়ে থাকে।

আদালত পিটিশনটি খারিজ করার পেছনে মূলত দুটি কারণ রায়ে উল্লেখ করেন। প্রথমত, বলা হয় গ্রামীণ এলাকায় একজন নারীর পক্ষে রাতে অথবা বর্ষার মৌসুমে বা নৌকা দিয়ে খাল পার হয়ে বিয়ের স্থানে পৌঁছানো অতিমাত্রায় দুরূহ হতে পারে, যে কারণে এ বিষয়গুলোকে নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই।

দ্বিতীয়ত, বলা হয়েছে ‘দ্রুত নগরায়ণ এবং একই সঙ্গে স্থান সংকুলানের অভাবের কারণে সম্প্রতি স্থানীয় মসজিদেই বিয়ে পড়ানোর প্রচলন শুরু হয়েছে।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে এখন নারীরা রেজিস্ট্রার হিসেবে লাইসেন্স পেতে পারেন না, কেননা মাসের ‘বিশেষ দিনগুলোতে’ একজন নারী মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না। ঋতুস্রাবের এ বিষয়কে আদালত আরও আখ্যা দিয়েছেন একটি ‘শারীরিক অযোগ্যতা’ হিসেবে।

প্রথমত, আইন এবং এর বিধিমালায় কোথাও বলা হয়নি, একজন নারী এ লাইসেন্স পাওয়ার অধিকারী নন। যে বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে আবেদন জমা হয়েছিল, সেখানে চাকরির ক্ষেত্রে একজন নারীর কোনো রকমের অযোগ্যতার কথা বলা হয়নি। একজন নারী মাদ্রাসা থেকে আলিম সার্টিফিকেট পেতে পারেন, কিন্তু কেন বিয়ে নিবন্ধনের লাইসেন্স পেতে পারেন না, সেই বিষয়টি বোঝা যায়নি। একজন নারী যদি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবেদন করেন, তবে তিনি নিশ্চয়ই এই কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত মনে করেন বলেই আবেদন করছেন। সে ক্ষেত্রে নারী মাঠঘাট পেরিয়ে বিয়ের স্থানে পৌঁছাতে পারবেন কি না, এ বিষয় আগেভাগেই সব নারীর জন্য ঠিক না করে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা সমীচীন।

দ্বিতীয়ত, যদি একজন নারী রেজিস্ট্রার মাসিক চলাকালে মনে করেন তিনি বিয়ে পড়ানো–সংক্রান্ত ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে চান না, তবে তিনি কিন্তু সে বিষয়টি থেকে বিরত থাকতেই পারেন। কেননা, আইনে তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে শুধু বিবাহ নিবন্ধন করা, ঋতুস্রাবের সঙ্গে যেই দায়িত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার মাসিক চলাকালে মনে করেন তিনি কোনো ধর্মীয় রীতি পালন করবেন না, তিনি সহজেই কোনো স্থানীয় মসজিদের ইমামকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন অথবা তাঁর অফিস সহযোগীকে পাঠাতে পারেন। বরং প্রচলিত প্র্যাকটিস হলো, অনেক ক্ষেত্রেই নিকাহ রেজিস্ট্রার তাঁর অফিস সহযোগীদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। মসজিদে বিয়ে করানোর বিষয়টিও খুব কমই দেখা যায় এবং সে ক্ষেত্রেও একইভাবে একজন রেজিস্ট্রার তাঁর সহযোগী বা মসজিদের ইমামকে দিয়ে বিয়ে পড়াতে পারেন, তাতে বিয়ের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় কোনো হেরফের হওয়ার কথা নয়।

আমাদের সংবিধান সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা আর আইনের চোখে সমতা নিশ্চিত করছে, নিশ্চয়তা দিচ্ছে নারী-পুরুষভেদে বৈষম্য না করার। বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে, আর প্রগতিশীল ধ্যানধারণাকে এগিয়ে নিতে উচ্চ আদালত আমাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেবেন, ন্যায়বিচারের গুরুদায়িত্ব যাঁর ওপর, তাঁর কাছ থেকে আমাদের আশা এতটুকুই।

তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক

taslima 47 @yahoo. com