নারীর জন্য ন্যায়বিচারের পথে এখনো যেসব বাধা

আন্তর্জাতিক নারী দিবস এমন একটি দিন যা সমাজে, রাজনীতিতে আর অর্থনীতিতে নারীর অসম অবস্থানের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার আহ্বান করে আর নারীর সমতার দিকে এগিয়ে চলাকে উদ্‌যাপন করে। লিঙ্গসমতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে দেশের আইনকাঠামো আর বিচারব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। আর এ কারণেই বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় নারীর অবস্থানকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে নারীর বৈষম্যমূলক অবস্থানকে পরিবর্তন করার জন্য একাধিক বিশেষায়িত আইন প্রণয়ন করা হয়েছে গত কয়েক দশকে। তবে নারীর প্রতি সহিংসতা-সংক্রান্ত বেশ কিছু বিধান এখনো যেমন ঔপনিবেশিক আমলে করা বৈষম্যমূলক আইন দিয়ে নির্ধারিত হয়, তেমনি পাশাপাশি নতুন আইনগুলোতেও পিতৃতান্ত্রিক ধরাবাঁধা ধ্যানধারণার প্রতিফলন রয়েছে। ধর্ষণ আর যৌন হয়রানির মতো অপরাধগুলো যে ভাষায় আমাদের প্রচলিত আইনে স্থান পেয়েছে, তা যে একেবারে প্রাচীন এবং অকার্যকর, সে বিষয়টি অনেকবারই জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে। ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করলেও এখনো যে ১৩ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের ক্ষেত্রেও তার ধর্ষক স্বামীকে অপরাধী হিসেবে আইনের আওতায় আনা যাবে না—এ বিষয়গুলোও ব্যাপক আলোচিত হয়েছে, তবে এর সমাধানের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি।

সরকারি–বেসরকারি এমনকি ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগগুলোও যখন একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় করে চলবে, তখনই নারীর ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। তবে সেই পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট নীতি নির্ধারণ করার সময় এখনই

২০১৮ সালে নতুন যৌতুক নিরোধ আইন পাস হলেও নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা কেন হলো, সেই বিষয়টি যেমন স্পষ্ট নয়, আবার যৌতুকের মামলায় ভুক্তভোগীকে যে কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হতে হয় অর্থাৎ ‘যৌতুক’-এর জটিল আইনি সংজ্ঞায় মামলা প্রমাণ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে, সেই সংজ্ঞাতেই কোনো পরিবর্তন করা হয়নি এই নতুন আইনে। বরং যৌতুকের সংজ্ঞাটিকে ভুক্তভোগীর জন্য আরও বেশি সংকুচিত করা হয়েছে, যা কিনা তা প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য।

২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতাসংক্রান্ত আইন করা হয়েছে, কিন্তু আইনটিতে পারিবারিক সহিংসতাকে মোটাদাগে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও পারিবারিক সহিংসতাকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে নতুনভাবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইন আনা হলেও সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে বিদ্যমান আইনটিতে একাধিক অসংগতি রয়েছে। আইনটিতে বাল্যবিবাহের শিকার ভুক্তভোগী মেয়েশিশুর জন্য সুরক্ষামূলক বিধান স্পষ্ট করা হয়নি, বরং নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে ভুক্তভোগী শিশুর জন্যই শাস্তিমূলক বিধান।

প্রচলিত পারিবারিক আইনেও নারীকে বৈষম্যমূলক অবস্থানেই রাখা হয়েছে। পারিবারিক আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকেই যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব, সে বিষয়টি বিভিন্ন ফোরামে সুপারিশ করা হলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তার খুব একটা প্রতিফলন দেখা যায় না। অন্যদিকে শ্রম আইনসংক্রান্ত বিধানগুলোতেও কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থানকে সার্বিকভাবে বিবেচনা করা হয়নি (যে কারণে যৌন হয়রানি শব্দটির উপস্থিতিই নেই পুরো আইনে)। তার ওপর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, যেখানে কিনা অধিকাংশ নারীশ্রমিক কর্মরত আছেন, সেখানেও নারীকে অন্তত সহিংসতামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর আইনি পরিবর্তন আনা হয়নি।

আবার আইনে প্রতিকার থাকলেও ন্যায়বিচার পাওয়ার পথটি নারীর জন্য এখনো একেবারে অসম। আইনের ফাঁকফোকর আর বৈষম্যমূলক বিধান যেমন তার বিচার পাওয়ার পথকে বাধাগ্রস্ত করে, তেমনি সামাজিক প্রথা, অসম অর্থনৈতিক অবস্থান আর বিচারব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতাগুলো তার বিচারের সুযোগকে আরও সংকুচিত করে। ধর্ষণ আর যৌতুক সহিংসতার মামলাগুলোর ক্ষেত্রে অনেক কম ভুক্তভোগী নারীই প্রাতিষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার আশ্রয় নেন। অনেক সময়ই এ ধরনের মারাত্মক অপরাধও গ্রাম্য সালিসে সমাধান করা হয়, যে সমাধানগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীর অনুকূলে থাকে না। আবার মামলা করা গেলেও ভুক্তভোগী এবং তাঁর সাক্ষীদের সুরক্ষার কোনো বিধান না থাকায় অনেক সময়ই মামলা পরিচালনা কষ্টকর হয়ে পড়ে। আর তার ফলে আসামি খালাস পেয়ে যায় মামলার দীর্ঘসূত্রতায়।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলো রয়েছে শুধু জেলা পর্যায়ে। একজন ভুক্তভোগী নারীর জন্য কোনো ধরনের পরিবহন বা সাময়িক আবাসনের ব্যবস্থা না থাকলে মামলা পরিচালনা তাই তার পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। একইভাবে ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে যে বিশেষ মেডিকেল পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, তা শুধু জেলার সদর হাসপাতালগুলোতেই হয়ে থাকে। যার কারণে কোনো দূরবর্তী এলাকা থেকে আসা ভুক্তভোগী নারীর জন্য অনেক সময়ই সঠিক সময়ে মেডিকেল পরীক্ষার সম্ভব হয় না, যা পরে তার মামলাকে দুর্বল করে দেয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রে সংবেদনশীল মেডিকেল পরীক্ষাসংক্রান্ত উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত আর সরকারি পর্যায়ে নির্দেশনা থাকলেও তার প্রয়োগ একেবারেই দুর্বল। পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার এবং চিকিৎসকের অভাব পূরণ করাও জরুরি। এ ছাড়া থানা এবং আদালত প্রাঙ্গণে নারীর জন্য সহায়ক পরিবেশ এবং কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।

ধর্ষণ আর অন্যান্য সহিংসতামূলক অপরাধের শিকার নারী ও শিশুদের একই সঙ্গে চিকিৎসা, আইনি সহায়তা, মনঃসামাজিক কাউন্সেলিংয়ের মতো বহুমাত্রিক সেবার প্রয়োজন হয়। আর এ কারণেই এসব ক্ষেত্রে যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ রয়েছে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় সাধন করাও প্রয়োজন। আমাদের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থাকলেও তা সংখ্যা অনুপাতে একেবারেই অপ্রতুল। আর সব কটিই রয়েছে বিভাগীয় পর্যায়ে। উপরন্তু ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার যে প্রকল্পের অধীনে কাজ করছিল, সরকারি তথ্যমতে এই বছরই তার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। প্রকল্পের বাইরে এ ধরনের বহুমাত্রিক সেবামূলক ব্যবস্থা কী করে মূল কাঠামোতে টেকসইভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

সরকারি আশ্রয় ও নিরাপদ হেফাজত কেন্দ্রও একেবারে সীমিত। বেসরকারি পর্যায়ে কিছু আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও সেগুলো একইভাবে অপ্রতুল। ভুক্তভোগী নারীর জন্য অন্তত সাময়িক আশ্রয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা গেলে আসলে আইনের সুরক্ষাগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ সম্ভব হয় না। গত বছরের একটি গবেষণায় উঠে এসেছিল যে কী করে রাষ্ট্রীয় বা বেসরকারি আশ্রয়ের অভাবে অনেক সময়ই পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী নির্যাতনকারীর সঙ্গেই ফিরে যেতে বাধ্য হয় কোনো বিকল্প আশ্রয় না পেয়ে। সামাজিক সুরক্ষাসংক্রান্ত উদ্যোগগুলোতেও ভুক্তভোগী নারীর জন্য বিশেষ সুযোগের ঘাটতি রয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতাসংক্রান্ত বিষয়ে তাই পর্যাপ্ত অর্থায়নের প্রয়োজন।

একই সঙ্গে আইন ও বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিরা রয়েছেন, তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জায়গাও তৈরি করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে। পুরো বিচারব্যবস্থাকে নারীবান্ধব করার জন্য শুধু বিচ্ছিন্ন প্রকল্পভিত্তিক প্রশিক্ষণ নয়, বরং সমন্বিতভাবে কী করে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনা যায়, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে যাঁরা দায়িত্বে নিয়োজিত, তাঁদের ক্ষেত্রেও নারীর অনুপস্থিতি প্রকট। নারীবান্ধব বিচারব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।

সর্বোপরি নারীর জন্য ন্যায়বিচারের পথকে সহজ করতে হলে আইনি কাঠামো, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আর বিচারব্যবস্থার পদ্ধতিগত আর কাঠামোগত পরিবর্তন একই সঙ্গে ভাবতে হবে। সরকারি–বেসরকারি এমনকি ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগগুলোও যখন একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় করে চলবে, তখনই নারীর ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। তবে সেই পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট নীতি নির্ধারণ করার সময় এখনই।

তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক