নারীর নামের পদবি পরিবর্তন

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও এবারের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের নাম জানে না এমন মানুষের সংখ্যা এখন কম। বিল ক্লিনটনের সঙ্গে বিয়ের পর আপনাআপনি ক্লিনটন পদবিটি জুড়ে গেছে তাঁর নামের সঙ্গে। কিন্তু তাঁর প্রকৃত নাম ছিল হিলারি ডিয়ান রডহাম। এখন উইকিপিডিয়া ছাড়া আর কোথাও তাঁর এ নাম দেখা যায় না। জানি না এ নিয়ে হিলারির মনে কোনো দুঃখ আছে কি না।

বোঝা যাচ্ছে, মেয়েদের নামের পদবিটি স্থায়ী কিছু নয়। বিয়ের আগে এক পদবি, বিয়ের পরে অন্য পদবি, বিবাহবিচ্ছিন্ন হলে আবার বাবার পদবি, আবার বিয়ে হলে আরেক নতুন পদবি।যেকোনো মানুষের নাম তঁার কাছে খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। কারও নাম বিকৃতভাবে উচ্চারণ করা হলে বা ভুল বানানে লেখা হলে, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে নারীরা তঁাদের নামের একাংশই বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছেন কী অবলীলায়।

শুধু বাঙালি নারীরা যে নিজেদের নাম বিসর্জন দিচ্ছেন, তা নয়। বিশ্বের বহু দেশের বহু নারী এই কাজ করছেন বা করতে
বাধ্য হচ্ছেন। যেমন জাপানি নারীদের তাঁদের নামের পাশে স্বামীর পদবি যুক্ত করা বাধ্যতামূলক। জাপানে বহু আগে নারীরা বিয়ের পরও তাঁদের পিতৃপ্রদত্ত নাম ধরে রাখতে পারতেন। কিন্তু ১৮৯৮ সালে নিয়ম পরিবর্তন করা হয় এবং পরিবারের সব নারী এবং শিশুর জন্য পরিবারের পুরুষপ্রধানের নাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। সম্প্রতি জাপানের আদালতে নারীদের স্বামীর পদবি গ্রহণের বাধ্যবাধকতা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তিন নারী এবং এক দম্পতি। তাঁরা তাঁদের আবেদনে বলেছিলেন, এই নিয়ম অসাংবিধানিক। তাঁদের চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ জারি করেছেন, জাপানের স্বামী-স্ত্রীর নামের পদবি অবশ্যই এক হতে হবে।

বাঙালি নারীদের নামের শেষে স্বামীর পদবির ব্যবহার করার রীতি কবে থেকে শুরু হয়েছে, তা জানা নেই। তবে ধারণা করি, এটা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব। আসলে স্বামীর এই পদবির ব্যবহার তো পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। ইউরোপ-আমেরিকাতে বিবাহিত নারীদের স্বামীর পদবি নেওয়াটা অনেকটাই বাধ্যতামূলক। আজকের আধুনিক ভারতেও এ রীতি ব্যাপকভাবে চালু আছে।

আমেরিকায় এখনো ৯০ শতাংশ বিবাহিত নারী নামের পাশে স্বামীর পদবি যুক্ত করেন। যেসব নারী তা করেন না তাঁদের অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ৫০ শতাংশ আমেরিকান মনে করে, স্বামীর পদবি গ্রহণ না করাটা অবৈধ (হোয়াই আর উইমেন স্টিল চেঞ্জিং দেয়ার লাস্ট নেম, দ্য হাফিংটন পোস্ট, ১০ নভেম্বর ২০১৫)। বিয়ে হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের কেন স্বামীর পদবি নিতে হবে, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করি, স্ত্রীরা যে স্বামীর অধীনস্থ তা বোঝানোর জন্যই সম্ভবত এই ব্যবস্থা চালু করা হয়।

আমাদের দেশে বিবাহিত নারীদের স্বামীর পদবি গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক না হলেও অনেক নারী তা করছেন। এ জন্য অবশ্য তাঁদের বিশেষ কোনো জটিলতা বা কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয় না। নামের সঙ্গে এত দিনের পদবি ফেলে দিয়ে স্বামীর পদবি লিখলেই হয়ে যায়। অনেক নারী এটাকে সাধারণ নিয়মরক্ষা বলেই মনে করেন এবং এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না। তবে অনেকে এটাকে স্বামীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মনে করেন। অনেকের মতে, এটা দাসত্বের লক্ষণ। তঁারা না চাইলেও স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির চাপে পড়ে স্বামীর পদবি গ্রহণ করেন। অনেক নারী আবার নামের পাশে বাবার এবং স্বামীর দুই পদবিই রাখেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন, অনর্থক এই পদবি পাল্টানো। তিনি এ নিয়ে ‘নামের পদবী’ শীর্ষক এক রচনায় লিখেছেন, ‘বিবাহিতা স্ত্রীর নামকে স্বামীর পরিচয়যুক্ত করা ভারতবর্ষে কোনো কালেই প্রচলিত ছিল না। আমাদের মেয়েদের নামের সঙ্গে তার পিতার বা স্বামীর পদবী জুড়লে প্রায়ই সেটা শ্রুতিকটু এবং অনেক স্থলেই হাস্যকর হয়। ইংরেজি নিয়মে মিসেস ভট্টাচার্য বললে তত দুঃখবোধ হয় না। কিন্তু মণিমালিনী সর্বাধিকারী কানে সইয়ে নিতে অনেক দিন কঠোর সাধনার প্রয়োজন হয়। যে-রকম আবহাওয়া পড়েছে তাতে য়ুরোপে বিবাহিত নারীর পদবী পরিবর্তন বেশি দিন টিকবে বলে বোধ হয় না, তখন আবার তাড়াতাড়ি আমাদের ও সহধর্মিণীদের নামের ছাঁট-কাট করতে যদি বসি তবে নিতান্ত নির্লজ্জ না হলে অন্তত কর্ণমূল লাল হয়ে উঠবে। একদা পাশ্চাত্য মহাদেশে মেয়েরা যখন নিজের নাম-স্বাতন্ত্র্য অবিকৃত রাখা নিয়ে আস্ফালন করবে সেদিন যাতে আমাদের মেয়েরা গৌরব করতে পারে সেই সুযোগটুকু গায়ে পড়ে নষ্ট করা কেন?’

তবে এটা ঠিক যে আমাদের দেশে শহুরে নারীদের নামের পাশে স্বামীর পদবি যুক্ত হলেও গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোতে এর বালাই নেই। সেখানে মোসাম্মত রহিমা খাতুন বা আসিয়া বেগমের নাম বিয়ের পরও তা-ই থাকছে। সেখানে পদবি পাল্টানোর জন্য কেউ তেমন ব্যতিব্যস্ত নয়।

স্বামীর পদবি গ্রহণ করাটাকে কেউ কেউ দাসত্বের লক্ষণ বলে বিবেচনা করতেই পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হচ্ছে স্বামীর নাম গ্রহণ না করেও আমাদের অনেক নারীকে স্বামীদের দাসত্ব করে যেতে হচ্ছে। তাঁদের অনেকে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আবার স্বামীর নাম গ্রহণ করলেও অনেক নারী স্বামীর দাসত্ব করছেন না। তাঁরা ঘরে-বাইরে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছেন।

আসলে স্বামীর নাম গ্রহণ করা বা না করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নারীর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। সেখানেই যদি সমস্যা থাকে বা তা যদি নিশ্চিত করা না যায়, তবে সবই অর্থহীন। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটি করতে নারী যেন পিছপা না হয়, সেটাই দেখতে হবে। নামে কিছু যায় আসে না। কাজ দিয়েই নারীদের নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। নারীকে নিজের মর্যাদা নিজেকেই রক্ষা করতে হবে।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক