নায়িকা, আন্ডারওয়ার্ল্ড ও মাফিয়াতন্ত্রের কারবার

উপমহাদেশে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি আর আন্ডারওয়ার্ল্ডের মধ্যে জৈবিক সম্পর্ক কিংবদন্তি হয়ে আছে। বলিউড নায়িকা মমতা কুলকার্নি বিয়ে করেন মাফিয়া লিডার বিবেক গোস্বামীকে। সুন্দরী প্রতিযোগী অনীতা আইয়ুবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কুখ্যাত দাউদ ইব্রাহিমের। অনীতাকে সিনেমার চরিত্রে না নেওয়ার রাগে দাউদ এক পরিচালককে হত্যাও করেন। জনপ্রিয় অভিনেত্রী দিব্যা ভারতীর মৃত্যু নিয়েও রহস্য আছে।

মন্দাকিনীর সঙ্গেও দাউদ ইব্রাহিমের সম্পর্ক নিয়ে কথা হয়। অনীল কাপুর, সালমান খান, শাহরুখ খানদের মতো বলিউডের রাজাদেরও গোপন জগতের মাফিয়া-কিংদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ বারবারই চাউর হয়েছে। সঞ্চয় দত্ত তো মুম্বাই বিস্ফোরণে জড়িত থাকার অভিযোগে জেলও খেটেছেন। ছোটা রাজন, ছোটা শাকীল, গুরু সাতমদের নাম অনেক নায়ক-নায়িকার সঙ্গেই জড়িত হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এঁরা বাধ্য হন, আবার কখনো কখনো ভালো ছবিতে কাজ পাইয়ে দিয়ে এঁদের কাছে টানে মাফিয়া মহাজনেরা।

মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে একদিকে শিবসেনা নেতা বাল থ্যাকারে, অন্যদিকে দুবাইয়ে পালিয়ে থাকা দাউদ ইব্রাহিমদের মতো সন্ত্রাসীদের সমঝে চলতে হয়। মাফিয়া-গ্যাং আর ফিল্মি ক্যারিয়ার চুলের বেণির দুই গোছার মতো জড়াজড়ি করে আছে সেখানে। বলা হয় বিশ্ববিখ্যাত হলিউড অভিনেত্রী মেরেলিন মনরো খুন হন মাফিয়াদের হাতে। গুজব আছে, মেরিলিনের প্রেমিক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হওয়ার প্রতিশোধ তারা নেয় মেরিলিনের শরীরে বিষ প্রয়োগে হত্যার মাধ্যমে। হলিউড জগতের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সম্পর্ক নিয়ে কয়েকটি সিনেমা বানিয়েছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ডেভিড লিঞ্চ। গডফাদার সিনেমাতেও দুর্বৃত্তবিলাস আর নায়িকাসঙ্গ একাকার হতে দেখি।

ঢালিউডও এই চক্রের বাইরে নয়। নব্বই দশকের পরে বিপুল কালোটাকা সাদা করার মওকা আসে। সিনেমায় বিনিয়োগের মাধ্যমে সেটা করা হয় বলে অভিযোগ আছে। এমনকি বাংলা সিনেমার একজন বিখ্যাত খলনায়ককে মাফিয়াবাজির অভিযোগে আটকও করা হয়েছিল। এই যে কালোটাকা, মাফিয়াতন্ত্র, উঠতি ধনিকশ্রেণি এবং রাজনৈতিক কর্তাবাবুদের যোগাযোগ, তার জরুরি উপাদান হলো নারী। আশি-নব্বইয়ের দশকের এক নামকরা গডফাদার সে সময়ের এক নায়িকা ও এক গায়িকার কন্যাকে অপহরণ করে রেখেছেন বলে অভিযোগ আছে। একসময়কার কুখ্যাত কালা জাহাঙ্গীরের সঙ্গেও জড়িয়ে গিয়েছিল রঙিন পর্দার কোনো মুখ।

২.
গত এক বছরে বড়োলোকি ক্লাব, অভিজাত হোটেল, নায়িকা কিংবা মডেলের ফ্ল্যাটের অনেক গল্প জনগণের কানে প্রচারিত হয়েছে। লাঠি হাতের লেডি দাবাং পাপিয়ার নারী নিয়ে কারবারের কথাও স্বয়ং পুলিশ জানিয়েছে। বিত্ত ও বিলাস খারাপ কিছু নয়। কিন্তু অবৈধ পথে অর্জিত বিত্ত লাগামছাড়া ভোগে লাগলে তা চারপাশকেও দূষিত করে।
বাংলাদেশ সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারা লোকদের দেশ। এখানে কেউ অল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে ৫-১০ বছরে হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারে। সামান্য শিল্পীসুলভ যোগ্যতা নিয়ে উঁচুতলার মানুষের হাত ধরে হয়ে যেতে পারেন বিরাট সেলিব্রিটি। শিক্ষক-সাংবাদিক-নিম্নপদস্থ কর্মচারী ক্ষমতাজালের সুতা ধরে হয়ে উঠতে পারেন মধ্যম বা উচ্চ ক্ষমতাশালী। সবার ক্ষেত্রে সেটি বলছি না।

বৈধ-অবৈধের সংজ্ঞা এই দেশে হরহামেশাই বদলে যায়। আইনের ঘরে চলতে পারে বেআইনি কারবার। রাজনীতির মধ্যে দুর্গ গড়তে পারে মাফিয়া নেতা। প্রশাসনের ডালে ডালে নেচে বেড়াতে পারে ভয়ানক দুর্নীতি। রাজনীতি-প্রশাসন-মাফিয়া মিলেই তৈরি হয়েছে বাংলাদেশিয় ক্ষমতার সংকর চরিত্র। চরিত্রটা ইংরেজ নাট্যকার শেক্‌সপিয়ারের দ্য টেম্পেস্ট নাটকের ক্যালিবানের মতো। ক্যালিবান অর্ধেক মানব আর অর্ধেক দানব। দেশের বড় বড় অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউসের কিছুটা দৃশ্যমান, কিছুটা চলে দুর্নীতির আলো-আঁধারিতে।

বাংলাদেশ সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারা লোকদের দেশ। এখানে কেউ অল্প পুঁজি হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারে। সামান্য শিল্পীসুলভ যোগ্যতা নিয়ে যেতে পারেন বিরাট সেলিব্রিটি। শিক্ষক-সাংবাদিক-নিম্নপদস্থ কর্মচারী ক্ষমতাজালের সুতা ধরে হয়ে উঠতে পারেন মধ্যম বা উচ্চ ক্ষমতাশালী।

সেই আলো-আঁধারিতে অর্থ, উপঢৌকন, মদ, সফর আর গাড়ি-বাড়ি-নারীর ব্যবহার ঘটবেই। পাশ্চাত্যের জগৎ শেঠেরা মহাকাশে বেড়িয়ে আনন্দ করেন, আমাদের দেশের বড়লোকদের সামনে নারী ও মদ ছাড়া আনন্দের উপকরণ তেমন নেই। অন্যদিকে মাফিয়াতন্ত্রের কাছে নারী খুবই আকর্ষণীয় মুদ্রা। রাজনীতিক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বশে আনতে নারীকেই ব্যবহার করা হয় মোক্ষম কোমলাস্ত্র হিসেবে।

৩.
আমাদের অর্থনীতির ৮৫ ভাগই অনানুষ্ঠানিক, কালোটাকা বলে পরিচিত অবৈধ সম্পদের পরিমাণ অপরিমিত। প্রায়শই রাজনীতির ঘরে অর্থনীতির কলের ভেতর সক্রিয় থাকতে দেখা যায় ক্রিমিনালদের। এ ধরনের অর্থনীতিকে বলা হয় ক্রিমিনাল অর্থনীতি। এই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার নাম দেওয়া যায় ঠগিতন্ত্র। এই ঠগিতন্ত্র কেবল বাংলাদেশের ব্যাপার নয়। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান এই পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে।

যুক্তরাজ্যের ইউসিএল প্রেস থেকে দ্য ওয়াইল্ড ইস্ট: ক্রিমিনাল পলিটিক্যাল ইকোনমিজ ইন সাউথ এশিয়া নামের একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় বললে, বুনো পূর্ব: দক্ষিণ এশিয়ার অপরাধমূলক রাজনৈতিক অর্থনীতি। সহজ ভাষায় রাজনৈতিক ঠগিতন্ত্রের অর্থনীতি। আমেরিকার বুনো পশ্চিমের মতো এটা হলো এশিয়ার বুনো পূর্ব। আমেরিকায় চলত সোনা নিয়ে বন্দুকবাজি। আমাদের এখানে চলে টাকা বানানোর ঠগবাজি। বসবাসের অযোগ্য, চরম বৈষম্যপূর্ণ, নোংরা ও অপরাধে ভরা নগরগুলোতে ক্ষমতাবানেরা গড়ে তোলে নিজস্ব স্বর্গ, বাহিনী আর রাজত্ব। গত এক দশকে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর বাংলাদেশে ঘটেছে, তার অপরাধজগতের আলো-আঁধারিতে এঁদের বিচরণ।

ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও দুর্বৃত্ত অর্থনীতি এই ধরনের ‘লিজেন্ড’, ‘গডফাদার’, ‘আম্মাজান’, ‘বড় ভাই’, ‘বস’, ‘দাবাং’ চরিত্রের উর্বর বীজতলা। ভোটের রাজনীতিতে সম্ভাবনা বজায় রাখতে রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত এদের খুঁটি পোঁতা থাকে। এসব চালাতে হলে থাকতে হয় আইনের ঊর্ধ্বে। আইনের লোকজনের সঙ্গে খাতির ছাড়া সেটা অসম্ভব। এরা রাষ্ট্রযন্ত্র ও দলীয় যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কলকবজা। রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের অপরাধীকরণের এজেন্ট এরা। এদের আশপাশেই মেলে রঙিন জগতের মানুষদের, তারা কখনো শিকার হন, কখনো হন টোপ।

৪.
ক্ষমতা থাকলে তা দেখাতে হয়। দেখাতে গেলে অন্যের অধিকার কাড়তে হয়, বলপ্রয়োগ করতে হয়। নারী হোক বা পুরুষ হোক, এই ক্ষমতা স্বভাবে দাপুটে। বরগুনার মিন্নি থেকে হালের নায়িকা পরীমনি এই ব্যাটাগিরির রাজত্বের মধ্যেই বেড়ে ওঠেন, থাকতে থাকেন পুরুষালি ক্ষমতার ছায়ায়। সম্রাট থেকে পাপিয়া, সাহেদ থেকে সাবরিনা, হেলেনা জাহাঙ্গীরা সেই ছায়াতলেই নিরাপদে বাড়তে থাকেন। উঠতে থাকেন উচ্চ নম্বরের সিঁড়িতে, যতক্ষণ না ভুল সময়ে ভুল জায়গায় পা দিয়ে ফেলেন। তাঁদের পর ‘পতিত’ উল্কা হিসেবে আলোচিত হচ্ছেন কথিত মডেল বা নায়িকাদের নাম। কেউ স্থানচ্যুত হলে মাফিয়াতন্ত্রেও যুক্ত হয়ে যায় ‘নতুন মুখ’।

বাংলাদেশের মানুষের পিঁপড়ার মতো জীবন। পিঁপড়ারা নিজের ওজনের চেয়ে আট গুণ বেশি ভারী জিনিস টানতে পারে। তেমনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে বহন করতে হয় বিপুল ওজনদার মাফিয়াদের অপকর্মের ভার। এই মাফিয়ারা উল্কার মতো। খুব দ্রুত উত্থান হয়। উঁচুতে উঠতে উঠতে যাঁরা নক্ষত্র হয়ে যান, তাঁদের ঘিরে থাকে জ্যোতির্ময়। তাঁদের পতন সহসাই আর হয় না। পতন হয় ছোট ছোট উল্কাপিণ্ডের। লেজে আগুন নিয়ে তাঁদের পতন দৃশ্য মানুষ দেখতে পায়। কিন্তু সব পতনের মধ্যে সুবিচার থাকে না। থাকে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলার সংগঠিত কারসাজি। মফস্বল বরগুনার মিন্নিকাণ্ড থেকে পরীমনিকাণ্ডকে কেবল কোনো অসাধু নারীর ‘পতন’ হিসেবে দেখা চলে না। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা হয়তো মাফিয়াতন্ত্রের হাতে জিম্মি, অনেক ক্ষেত্রে তাঁরাই ক্ষমতার খেলার করুণ শিকার। মাফিয়াতন্ত্রে নারীর অবস্থান খুবই নাজুক। কতজন যে জানালার লোভে ঘর বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হলো, সেই খবর কে রাখে?

পরীমনি কিংবা মৌ বা পিয়াসাদের কাহিনির উল্টো পিঠটাও দেখতে হবে। এটা কোনো নৈতিক মামলা নয়, এটা হলো মাফিয়াতন্ত্রের হাতে জিম্মি ও ব্যবহৃত নারীদের সংগ্রাম, আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং হঠাৎ পতনের এক ট্র্যাজিক গল্প। নৈতিকতার গল্পে মজে থাকলে ভেতরকার নিষ্ঠুর রাজনৈতিক অর্থনীতিটা ঢাকা পড়ে যায়।

ফারুক ওয়াসিফ সাংবাদিক ও কবি।
faruk. wasif@prothomalo. com