নিজের তথ্যের সুরক্ষা নিজেকেই করতে হবে

ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ২৮ জানুয়ারি, ১৯৮১ সালে প্রথম গোপনীয়তা এবং তথ্য সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। তারপর থেকেই প্রতিবছর ২৮ জানুয়ারি তথ্য সুরক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই দিবসের উদ্দেশ্য ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সচেতন করা, কীভাবে নিজের ও অন্যের তথ্যের গোপনীয়তাকে সম্মান ও সুরক্ষিত করা যায় এবং পরস্পরের প্রতি আস্থা তৈরি করা। দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াশিংটনভিত্তিক জাতীয় সাইবার সিকিউরিটি অ্যালায়েন্স (এনসিএসএ) নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা দিবসটি অনুসরণ করে থাকে।

২০২১ সালে এই দিবসের প্রতিপ্রাদ্য বিষয় ‘নিজের তথ্যের সুরক্ষা করুন’। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সমসাময়িক সমীক্ষা ও প্রতিবেদনগুলিতে দেখা যাচ্ছে, আমরা ক্রমবর্ধমানভাবে নিজস্ব তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি। বর্তমান বিশ্বে তথ্যই সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। যার কাছে যত অন্যের তথ্য আছে, সে তত বেশি সম্পদশালী। তাই বিনা মূল্যে সেবা দেওয়ার পরও ফেসবুক, গুগল, টুইটারের মতো সংস্থাগুলি দিন দিন বিশাল দৈত্যাকার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। এসব সংস্থা আমাদের তথ্য বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রি করে অর্থ কামাচ্ছে।

সাধারণত তিন প্রকার তথ্য পাওয়া গেলে সেই তথ্যের মালিককে শনাক্ত করা সম্ভব। প্রথমটি হচ্ছে ‘কে’—নাম, ফোন নম্বর, জাতি, লিঙ্গ, বয়স, উচ্চতা, ওজন ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি ‘কী’—শিক্ষার স্তর, রাজনৈতিক বিশ্বাস, পেশা, বৈবাহিক অবস্থা, সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম ইত্যাদি। তৃতীয় প্রকারটি ‘কোথায়’—শপিংয়ের জায়গা, কাজের জায়গা, প্রার্থনার জায়গা ইত্যাদি, এককথায় বিচরণক্ষেত্র।

এই তিন প্রকার তথ্য এক সুতায় বাঁধলে সহজেই একজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এ জন্য একে বলা হয় ব্যক্তিগত শনাক্তযোগ্য তথ্য (পারসোনাল আইডেন্টিফায়েবল ইনফরমেশন—পিআইআই) আমেরিকান ম্যানেজমেন্ট পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিন্সির অনুমান অনুযায়ী শুধু ব্যক্তিগত অবস্থানের তথ্যের মূল্য আগামী কয়েক বছরে আট লাখ কোটি টাকার বেশি হবে। বিখ্যাত অ্যান্টিভাইরাস সংস্থা ম্যাকাফির হিসাব অনুযায়ী, ৮২ শতাংশ অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ব্যবহারকারীর অনলাইন ক্রিয়াকলাপ ট্র্যাক করে এবং প্রায় ৮০ শতাংশ অ্যাপ লোকেশন তথ্য সংগ্রহ করে।

ফিউচার ক্রাইমস গ্রন্থের লেখক মার্ক গুডম্যানের ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী আমেরিকার ডেটা ব্রোকার অ্যাক্সিওম করপোরেশন বিশ্বব্যাপী ৭০০ মিলিয়নেরও বেশি গ্রাহকের ১ হাজার ৫০০ ধরনের বৈশিষ্ট্যের তথ্য ২০ হাজারের বেশি সার্ভারে জমা রেখেছে এবং প্রতিনিয়ত তা বাড়ছে। এসব সংস্থা সম্পত্তির রেকর্ড, বিয়ের লাইসেন্স এবং আদালতের মামলা ইত্যাদি উৎস থেকে তথ্য সংকলন করে। তারা ব্যক্তির চিকিৎসার রেকর্ড, ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের ইতিহাস, সোশ্যাল মিডিয়া সংযোগ এবং অনলাইনে কেনাকাটার তথ্যও সংগ্রহ করতে পারে।

আমরা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিগত তথ্য না বুঝেই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছি। আমরা ভাবছি এটা নিরাপদ। কিন্তু ইন্টারনেটে যেকোনো তথ্যই উন্মুক্ত। আপনি যাকে তথ্য দিচ্ছেন, হয় সে সেটা অন্যের কাছে বিক্রি করছে, অথবা হ্যাকাররা চুরি করে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে বা অন্যের কাছে বিক্রি করছে। হ্যাকার শুধু ব্যক্তি বা সংগঠিত গোষ্ঠীই নয়, রাষ্ট্র, দেশি–বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা বা তাদের এজেন্টরাও হ্যাকিং করতে পারে।

বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান, যাদের আপনি বিশ্বাস করে তথ্য দেন, তারা আপনার পুরোনো তথ্য মুছে ফেলে না। আপনি নিজের প্রোফাইল মুছে ফেলার পরও ফেসবুক সেটা তার সার্ভারে অনেক দিন রেখে দেয়। আর বলা হয়, গুগল কখনোই কারও কোনো তথ্য মোছে না। এই ধরনের সংস্থার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ইউরোপে ব্যবহারকারীর তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা লঙ্ঘন, ব্যবহারকারীর তথ্যের অনৈতিক ব্যবহারের অভিযোগে অনেক মামলা হয়েছে, প্রতিনিয়ত হচ্ছে।

আমরা দিন দিন আরও ডিজিটালাইজড এবং আরও সংযুক্ত হচ্ছি। এটা কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। তাহলে আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা সুরক্ষার জন্য কী করব? এর সহজ উত্তর হচ্ছে আমাদের সচেতন হতে হবে। অনলাইনে আমরা কী তথ্য তৈরি করছি এবং কীভাবে সেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়, শেয়ার করা হয় এবং কীভাবে ব্যবহৃত হয় সে সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। কোনো অ্যাপ্লিকেশন বা সংস্থা চাইলেই আপনার তথ্য দেওয়া ঠিক হবে না। আপনি যেসব উপকার পেতে পারেন, সেটা বিবেচনা করে আপনার তথ্য শেয়ার করবেন কি না, সে সম্পর্কে অবগত হয়ে সিদ্ধান্ত নিন। অনেক অ্যাপ্লিকেশন তাদের পরিষেবা ব্যবহার করার আগে ব্যবহারকারীর ভৌগোলিক অবস্থান, পরিচিতি তালিকা এবং ফটো অ্যালবামের অ্যাক্সেসের অনুমতি চায়।

কে তথ্যটি পাচ্ছে, সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করুন এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলি সম্পর্কে সতর্ক হোন। তাদের পরিষেবার জন্য প্রয়োজনীয় বা প্রাসঙ্গিক নয়, এমন তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। অব্যবহৃত অ্যাপ্লিকেশনগুলি আপনার ডিভাইস থেকে মুছে ফেলুন এবং ব্যবহৃত অ্যাপ্লিকেশনগুলি নিয়মিত আপডেট করে আপনার ডিভাইস এবং তথ্য সুরক্ষিত রাখুন। ওয়েব পরিষেবা এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে গোপনীয়তা ও সুরক্ষা সেটিংস নিয়মিত চেক করুন। যে পরিমাণ তথ্য শেয়ার করা প্রয়োজন বলে আপনার মনে হয় ততটুকুই শেয়ার করুন। আপনার ব্যবহৃত ডিভাইস, অ্যাপ্লিকেশন বা ব্রাউজারের তথ্য শেয়ারের অপশনগুলো সীমাবদ্ধ করুন।

এই সংযুক্ত বিশ্বে আমাদের নিজস্ব তথ্য সুরক্ষার সর্বোত্তম উপায় সচেতন হওয়া। কাকে তথ্য দেবেন, এবং কেন তথ্য দেবেন—শুধু এই দুটি বিষয়ে সব সময় সতর্ক থেকে আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারি; অযাচিত পরিস্থিতি এড়াতে পারি।

এম এ হক টেলিকমিউনিকেশন এবং সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত।