নিতি তো বাঁচতেই চেয়েছিল

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সব থেকেও কিছু ছিল না নিতির। মা-বাবার কাছে ঠাঁই হয়নি। নানা-নানিও দূরে ঠেলে দেন। শেষে আশ্রয় জোটে দাদির কাছে। অথচ দোষ কিছু ছিল না ১১ বছরের ছোট্ট মেয়েটির। আপনজনদের অনাদর, অবহেলা, প্রত্যাখ্যান, নির্মমতায় কচি বুকটা ভারী হয়ে ওঠে পাহাড়সম বেদনায়। তারপর যা ঘটল, এখনই তা মুখ ফুটে বলা যাবে না। কারণ, এটি আত্মহত্যা না অন্য কিছু, তা তদন্তসাপেক্ষ। এখন শুধু এটুকুই বলা যায়—পৃথিবীর মানবসমুদ্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে নিতি নামের একটি কণা, যার মৃত্যুতে কারও কিছুই আসে-যায় না। শুধু থেকে যায় বিশাল এক প্রশ্ন।

নাতনি নিতিকে ঘরে রেখে বাইরে গিয়েছিলেন দাদি। ফিরে দেখেন, ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলছে নিতির ফাঁস লাগানো নিথর দেহ। পাওয়া গেল চিরকুট। সেখানে একবুক অভিমানঝরা কথা। সবার অবহেলা, অনাদর, উপেক্ষা থেকে যে অন্তর্জ্বালায় পুড়ছিল, এ যন্ত্রণা জুড়াতেই এ পথ বেছে নিয়েছে সে। চিরকুটে লেখা ছিল তা–ই।

প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এ বিষয়ে নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বছির আহমেদ বলেন, ‘আমরা নিতির লেখা চিরকুট ও তার লেখাপড়ার খাতা মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, চিরকুটটি নিতিই লিখেছে। নিতির চিরকুটের লেখা ধরে তদন্ত চলছে।’

নিতি আর নেই—এই কঠোর সত্যকে ঘিরে তদন্ত চলতে থাকুক। আমরা একটু পেছন ফিরে দেখি।

১৫ বছর আগে নিতির বাবা আন্ধারুপাড়া গ্রামের মো. আল আমিন বিয়ে করেন ঝিনাইগাতী উপজেলার তিনানী বাজারের ইয়াসমিন আক্তারকে। বিয়ের চার বছর পর নিতির জন্ম। ২০১৪ সালে নিতির বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ২০১৫ সালে নিতির মা-বাবার ছাড়াছাড়ি। পরে নিতির মা আবার বিয়ে করে স্বামীকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। কাজ নেন পোশাক কারখানায়। নিতির বাবাও দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। অভিভাবকহীন নিতি একলা পড়ে থাকে অসহায়। কে নেবে তার দায়িত্ব? নানা-নানি মুখ ফিরিয়ে নেন। শেষে দাদি আর ওকে ফেলতে পারেননি। কিন্তু আশ্রয় বা থাকা–পরার সামান্য একটা হিল্লেই নিতির মতো শিশুর জন্য সবকিছু নয়।

এ বয়সের একটি কন্যার মধ্যে অনেক সাধ-আহ্লাদ থাকে। মা-বাবার কাছে থাকে অনেক আবদার-অনুযোগ। কিন্তু সে দুজন সংসারের সুখপাখি ধরতে ভিন্ন দুটি ঠিকানায়। কে করবে নিতিকে আদর, কে ভাঙাবে তার নীরব অভিমান? কেই–বা নিতিকে দেখাবে ভবিষ্যতের আলো? বলবে আগামী দিনের সুন্দর সম্ভাবনার কথা? বয়স্ক দাদির কতই–বা আছে সামর্থ্য? ছোট্ট মেয়েটি যেদিকেই তাকিয়েছে, দেখেছে অনিশ্চয়তার ঘোলা জল। পায়নি কোনো নির্ভরতার হাত, যে হাত ধরে পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাবে অনাগত নতুন দিনের দ্বারে।

কল্পনা আর বাস্তবতা মিলিয়ে নিভৃত ঝরে যাওয়া নিতির দুঃসহ এই নীরব কষ্টের ছবি আঁকতে পারি আমরা। কিন্তু পারিবারিক ভাঙন আর বিচ্ছেদের কারণে দুরবস্থায় থাকা এমন অনেক নিতির জন্য কি নির্ভরতার অবলম্বন হতে পারি?

এ ব্যাপারে মূল ভূমিকাটি থাকা উচিত ওই শিশুর মা-বাবার। দেশে দাম্পত্য বিচ্ছেদ বা তালাক পরিস্থিতি সুবিধার নয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকাতেই প্রতি ঘণ্টায় একটি করে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে। সব মানুষই সুখের জন্য সংসার পাতেন। আমৃত্যু দাম্পত্য জীবন টিকে থাকবে, এমন লক্ষ্য নিয়েই বেশির ভাগ নারী-পুরুষ জীবনসঙ্গী বেছে নেন। ঘটা করে ঘর বাঁধেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নানা কারণে দাম্পত্য জীবনে অশনিসংকেত দেখা দেয়।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন, পরনারী বা পরপুরুষে আসক্তি, নৈতিক স্খলন, ফেসবুক ও মাদকাসক্তি, পরস্পরের প্রতি অনাগ্রহ, অভাব-অনটন, পুরুষত্বহীনতা—এসব কারণে ঘর ভেঙে যায়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেকায়দা পড়ে বিচ্ছেদের গ্যাঁড়াকলে পড়া সন্তানেরা। বিশেষ করে শিশুসন্তান। অবোধ শিশুর অপক্ব মাথায় কিছুতেই ধরে না যে বাবা কেন আরেক নারীকে বিয়ে করলেন? কিংবা মা কেন আরেক পুরুষের সঙ্গে গেলেন? কিংবা মা-বাবা কেন আলাদা হয়ে যাবেন?

বিচ্ছেদের ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মা ও বাবা যাঁর যাঁর কাছে সন্তানকে রেখে দেওয়ার জন্য অটল রয়েছেন। সে ক্ষেত্রে ঘটনাটা রীতিমতো রশি–টানাটানির মতো হয়। সন্তানের এক হাত ধরে এক দিকে মা, আরেক হাত ধরে আরেক দিক থেকে বাবা টানলে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তা সহজেই অনুমেয়।

সন্তান কার কাছে থাকবে, কীভাবে থাকবে, এর আইনি সমাধান আছে। পারিবারিক বা সামাজিক সমাধানও আছে। আত্মহত্যাও কোনো সমাধান নয়। সমাজ মানবিক হলে, পরিবারের মানুষ আরও বুঝদার ও সহৃদয় হলে হয়তো নিতিদের এমন পরিণতি হবে না। এ ঘটনা আমাদের নিতির মতো শিশুদের আগলে রেখে বড় করার দায়িত্ববোধ বাড়াতে বলে।

মা-বাবার বিচ্ছেদের মধ্যে বেড়ে ওঠা সন্তানের মানসিক, সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ কখনোই স্বাভাবিক হতে পারে না। মা-বাবা আলাদা হওয়া মানেই একটি সন্তানের কাছে দুনিয়া দুভাগ হয়ে যাওয়া। কাছের চিরচেনা জগৎটা অচেনা হয়ে যাওয়া। কাউকে আপন বা নিজের করে মেনে নিতে তাদের কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক।

মানুষের মনটা হচ্ছে কাচের মতো। তাকে সযত্নে আগলে রাখতে হয়। মন একবার ভাঙলে সহজে জোড়া লাগে না। ভাঙা কাচ জোড়া দিলে যেমন দাগ থেকে যায়, মন জোড়া লাগাতে গেলেও দাগ থাকে। এ জন্য বিচ্ছেদ ঘটানো মা-বাবার সন্তানদের মন থাকে ভাঙা কাচের মতো। তাই প্রত্যেক দম্পতির বিচ্ছেদ ঘটানোর আগে অবশ্যই সন্তানের নিষ্পাপ মুখ আর নির্মল মনের দিকে তাকানো উচিত। তারা তো কোনো দোষ করেনি।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও লেখক
[email protected]