নিম্ন আয়ের মানুষ কেন বোতলের তেল কিনতে বাধ্য হবে

ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে সীমিত আয়ের মানুষ। যাঁদের এক লিটার, পাঁচ লিটারের তেলের বোতল কেনার সামর্থ্য নেই, তাঁরা অল্প পরিমাণে খোলা তেল কিনে কাজ চালিয়ে নেন
ছবি: প্রথম আলো

ভোজ্যতেল নিয়ে কী তেলেসমাতি চলছে গোটা দেশে। ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিস্থিতি ও করোনা–পরবর্তী বিশ্বমন্দার কারণে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ারই কথা। সেটি নিশ্চয়ই শুধু বাংলাদেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও। তাই বলে ভোজ্যতেল নিয়ে এ দেশে যা ঘটল, তা অন্য কোনো দেশে ঘটেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। দাম বাড়ানোর একটি প্রক্রিয়া তো অবশ্যই আছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দাবি মেনে নিয়ে সরকারও দফায় দফায় দাম বাড়াল। তাই বলে কখনো কারখানায়, কখনো গুদামে তেল মজুত করে মানুষকে এভাবে জিম্মি করা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। একটা সয়াবিন তেলের বোতল যেন কোরবানির পশুর মতো হয়ে গেছে। রাস্তায় কারও হাতে তেলের বোতল দেখলেই মানুষ জিজ্ঞাসা শুরু করে দেয়—কত নিল? তেলের জন্য এমন হাহাকার অবস্থায় খোলা সয়াবিন তেলও দুর্লভ হয়ে উঠল যেন। নিম্ন আয়ের যেসব মানুষ দিনের তেল দিনে কিনে রান্নার কাজ সারেন, তাঁরা পড়ে গেলেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ অবস্থায়। সাশ্রয়ী মূল্যে তেল কিনতে এদেরই মূলত দৌড়াতে দেখেছি আমরা টিসিবির ট্রাকের পেছনে। কারণ, বাজারে খোলা সয়াবিন তেল নিয়েও কারসাজির শেষ নেই।

ঈদের পরপরই সরকারের এক ঘোষণায় এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১৯৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৩৬ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। সামর্থ্যবানেরা তো বিষয়টিকে সরকারের ‘ঈদ উপহার’ বলে হাস্যরসও করল। বাজারে সয়াবিন তেল গায়েব হয়ে গেলে তাদের কী আসে–যায়! এরপর আমরা মজুতদারির বিশাল দৃষ্টান্ত দেখলাম। সরকারি অভিযানে ‘চিচিং ফাঁক’-এর মতো লাখ লাখ লিটার সয়াবিন তেল বেরিয়ে এল। আগের দামে কেনা তেল নতুন দামে বিক্রি, পারলে আরও বেশি দামে বিক্রি, গায়ের দাম তুলে ফেলা, বোতল কেটে বেশি দামে তেল বিক্রি—কতই না নাটকীয়তা হাজির হলো গোটা দেশে। এক দিকে তেল না থাকার কৃত্রিম সংকট তৈরি, অন্যদিকে বন্দরে হাজার হাজার টন তেল পৌঁছানোর খবর আমরা দেখি। এমন পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী—তেল কোম্পানিগুলো, ব্যবসায়ীরা, পাইকারি ব্যবসায়ীরা নাকি সরকার? যদিও এর মধ্যে, সেবা সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে দেশের ভোজ্যতেল আমদানিকারক আট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।

কয়েক মাস ধরে আমরা দেখি, তেল কোম্পানিগুলো দোষ দেয় ডিলার বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের, আবার তারা দোষ দেয় কোম্পানিগুলোকে। এখন পাইকারি ব্যবসায়ী বা ডিলারদের গুদাম থেকে লাখ লাখ বোতল উদ্ধার করা হচ্ছে, সেগুলো নিশ্চয়ই তাঁরা বাজার থেকে ঘুরে ঘুরে কিনে মজুত করেননি। দাম বাড়ার এক–দুই মাস আগে থেকে একসঙ্গে এতসংখ্যক তেলের বোতল তাঁদের হাতে গেল কী করে, সেই প্রশ্নও থেকে যায়। অন্যদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী অসহায়ত্বের সঙ্গে বলে দিলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে ভুল করেছি।’ মানুষ যে তাদের ওপরে বিশ্বাস রেখে কত ভুল করেছে, সেটি যদিও মন্ত্রী মহোদয়দের কিছু যায়–আসে না।

তেল নিয়ে তেলেসমাতির জন্য যাঁরাই দায়ী হোক না কেন, চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের দিনমজুর বিবি কুলসুম নিজের কপালকেই দায়ী করেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখি, দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দুই-চার ছটাক করে তেল কিনে কোনোমতে দিন চালাতে হয় তাঁদের। এমন অনেক কুলসুমই ভিড় করেন ঢাকার বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁওয়ের দিকে যেতে উড়ালসড়কের নিচে ‘গরিবের বাজারে’। সেখানে সর্বনিম্ন দশ টাকায় ছোট এক পুঁটলি সয়াবিন তেল কিনতে পাওয়া যেত। ক্রমাগতভাবে দাম বাড়তে থাকায় গত ফেব্রুয়ারি থেকেই সেখানে এখন আর ১০ টাকার সেই তেলের পুঁটলি পাওয়া যায় না। সেটির দামও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে নির্ঘাত। এরপরও এমন পুঁটলি-তেলই তাঁদের কিনতে হয়। কারণ, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর কাছে খোলা তেলই হচ্ছে বড় ভরসা। এক বা দুই ওয়াক্তে যতটুকু তেল লাগে, সেটুকুই তাঁরা কিনতে পারেন। এখন খোলা তেলও গায়েব হয়ে গেলে বোতল কেটেই অনেক দোকানে তেল বিক্রি হতে দেখি আমরা। খোলা তেলের দাম তুলনামূলকভাবে কম, এখন বোতল কেটে বেশি মূল্যেই অল্প কয়েক ছটাক করে বিক্রি করায় অনেককে কিন্তু জরিমানাও করা হচ্ছে। এরপরও কি এভাবে খোলা তেল বিক্রি থামানো সম্ভব?

দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দুই-চার ছটাক করে তেল কিনে কোনোমতে দিন চালাতে হয় বিবি কুলসুমদের মতো খেটে খাওয়া মানুষদের। বহদ্দারহাট, চট্টগ্রাম
ছবি: প্রথম আলো
এখন বিশ্বমন্দার যে আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে, সেখানে সব ধরনের তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করা ও ন্যূনতম চাহিদা মেটানোই সরকারের সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হওয়ার কথা। যুগ যুগ ধরে জনসংখ্যার বিশাল অংশের মানুষ খোলা তেলের ওপর নির্ভরশীল। এমন সংকটময় মুহূর্তে সেটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সংকট আরও বাড়িয়ে তোলা কোনোভাবেই যুক্তিসংগত হতে পারে না।

বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল থেকেও খোলা সয়াবিন তেল ও খোলা পাম তেলের চাহিদা বেশি। বলতে গেলে সয়াবিন তেলের ৬০ শতাংশ ও পাম তেলের ৯৭ শতাংশই খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়। এসব খোলা তেলের চাহিদা সব সময় এ রকমই থাকবে। কারণ, এ দেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ নিম্ন ও মাঝারি আয়ের। তাঁরা সব সময় বোতলজাত তেল কিনতে পারেন না। আর হোটেল-রেস্তোরাঁয়ও বোতলজাত সয়াবিন বা পাম তেলে কখনো পোষায় না। ড্রামে ড্রামে তাঁদের খোলা তেলই কেনা লাগে। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেই খোলা তেল বিক্রি বন্ধ করে দিতে চায়। তাদের যুক্তি হচ্ছে, খোলা তেলে ভেজাল হয়। অনেকে বোতল কেটে বিক্রি করে। দাম লেখা থাকে না। বেশি দামে বিক্রি করে। মধ্যস্বত্বভোগীরা মজুত করার চেষ্টা করছে। সেদিনের সভায় বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা এমনটি পাই। কিন্তু গত কয়েক মাসে মজুতদারির চিত্র তো আমরা দেখলামই। সেটি বোতলজাত তেলের ক্ষেত্রেও হয়েছে। আর পাম তেলের দাম কম হওয়ায় খোলা সয়াবিন তেলের সঙ্গে সেটি মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। তবে সেই ভেজালের বাস্তবতা এখন অনেকাংশেই কমে এসেছে, কারণ খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম এখন অনেকটা কাছাকাছি।

আরও পড়ুন

আগামী ৩১ মের মধ্যে বাজারে খোলা সয়াবিন বন্ধের ডেডলাইন ঘোষণা দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর খোলা পাম তেল বিক্রির নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের পর। গত মার্চের শুরুতে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এ সিদ্ধান্ত জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সে সময় টিসিবির ট্রাকের সামনে তেলের বোতল কিনতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। এখনকার অবস্থা তো শুরুতেই উল্লেখ করা হলো। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কেন সরকার খোলা ভোজ্যতেল নিয়ে এত চিন্তিত হয়ে পড়ল, সেটিই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত তেল বোতলে ভরে বিক্রিতে আগ্রহী দেশের বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মনে করেন, এতে তেলের বাজার পুরোটা কয়েকটি বড় কোম্পানির হাতে চলে যাবে। বোতলজাতকরণে খরচ বাড়বে। এখন কোম্পানিগুলো এক লিটারের বোতলের খরচ ধরে ১৫ টাকার মতো। আর ৫ লিটারের একটি বোতলের ব্যয় ৫০ টাকা ধরে হিসাব করে। পুরো বাজার চার-পাঁচটি কোম্পানির হাতে চলে গেলে তারা তখন নিজেদের মতো দাম নির্ধারণ করবে।

আবার খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মূলত চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা। খোলা পাম তেলের বাজারটা হচ্ছে এমন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশেও হু হু করে দাম বাড়ে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে এখানেও দাম পড়ে যায়। যার কারণে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও কম দামে খোলা পাম তেল বিক্রি হচ্ছে খাতুনগঞ্জে ও মৌলভীবাজারে, যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেছে। এখন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গোটা তেলের বাজারটিই কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এর ফলে তাদের পণ্যের দাম বাড়তে থাকলে বাড়তেই থাকবে, স্বাভাবিকভাবেই সেটি আর কখনো কমবে না। ভোক্তারাও সেসব কোম্পানির হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে।

এখন বিশ্বমন্দার যে আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে, সেখানে সব ধরনের তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করা ও ন্যূনতম চাহিদা মেটানোই সরকারের সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হওয়ার কথা। যুগ যুগ ধরে জনসংখ্যার বিশাল অংশের মানুষ খোলা তেলের ওপর নির্ভরশীল। এমন সংকটময় মুহূর্তে সেটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সংকট আরও বাড়িয়ে তোলা কোনোভাবেই যুক্তিসংগত হতে পারে না। এখন তেলে ভেজাল হয়ে থাকলে, সেটি রোধ করতে নিয়মিত অভিযান ও মনিটরিং বাড়ানো হোক। আবার পাইকারি বা খোলাবাজারে অনিয়মের জন্য তৎক্ষণাৎ বিপুল টাকা জরিমানা করা হবে কিন্তু কোনো কোম্পানির কারখানায় অনিয়ম ধরা পড়লে তাদের শুধু সতর্ক করা হবে—এমনটি যেন না হয়। তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখা, অনিয়ম ও ভেজালমুক্ত রাখা যেমন মন্ত্রণালয়সহ সরকারি নিয়ন্ত্রক ও তদারকি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব, তেমনি পুরো বাজারে কারও একচেটিয়া আধিপত্য রোধ করাও তাদের দায়িত্ব। আমরা চাই না নিম্ন আয় বা সীমিত আয়ের মানুষ বোতলজাত তেল কিনতে বাধ্য হোক।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক