নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে গণশুনানি জরুরি

বহু তর্কবিতর্কের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধান কমিটিতে সভাপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে। তিনি আগের অনুসন্ধান কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। সেই অনুসন্ধান কমিটি নিয়ে জাতির অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বর্তমান নূরুল হুদা কমিশন গঠনে ওই অনুসন্ধান কমিটির ভূমিকা রয়েছে। বিতর্কিত এই কমিশনের অধীন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনুসন্ধান কমিটির আরেক সদস্য সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন। তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কেননা, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন।

ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গত রোববার প্রথম বৈঠকটি করেছে। গণমাধ্যমের সংবাদে জানা যাচ্ছে, গতবারের অনুসন্ধান কমিটি যে কর্মপদ্ধতিতে কাজ করেছিল, এবারের কমিটিও সেই পদ্ধতিতে কাজ করবে। বৈঠকে অংশ নেওয়া অনুসন্ধান কমিটির একজন সদস্য দৈনিক ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘গতবার সার্চ কমিটি যেভাবে কাজ করেছিল, এবারও সেভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মতামত চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে সুশীল সমাজ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করব। যে নাম আসবে তা যাচাই-বাছাই করে সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করা হবে। সেখান থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য দুই এবং চারজন কমিশনারের জন্য আটজন ব্যক্তির নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা হবে।’

বর্তমান অনুসন্ধান কমিটি যদি আগের অনুসন্ধান কমিটির মতো একই ধারায় কাজ করে, তাহলে এর থেকে ভালো কিছু পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন তৈরি হয়। পুরোনো পথে হাঁটলে নতুন গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে না। আমাদের প্রত্যাশা, অনুসন্ধান কমিটি যেন এমন একটি কার্যপদ্ধতি গ্রহণ করে, যাতে সত্যিকারের অনুসন্ধানের সুযোগ থাকে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারলে প্রকৃতপক্ষে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য সার্থক হবে। এর বদলে সরকারের আস্থাভাজন ও অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগের সুপারিশ করলে কিংবা লোকদেখানো অনুসন্ধান করলে তার ফলাফল ভালো হবে না। নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এবারের অনুসন্ধান কমিটি যদি ব্যর্থ হয়, তবে জাতি হিসেবে আমরা মহাবিপর্যয়ের দিকেই ধাবিত হব।

জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারলে প্রকৃতপক্ষে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য সার্থক হবে। এর বদলে সরকারের আস্থাভাজন ও অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগের সুপারিশ করলে কিংবা লোকদেখানো অনুসন্ধান করলে তার ফলাফল ভালো হবে না। নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এবারের অনুসন্ধান কমিটি যদি ব্যর্থ হয়, তবে জাতি হিসেবে আমরা মহাবিপর্যয়ের দিকেই ধাবিত হব।

গত ২৭ জানুয়ারি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এতে নতুন কিছু নেই, মূলত এর মাধ্যমে অতীতের অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপনকেই আইনের পোশাক পরানো হয়েছে মাত্র। অনেকের মনেই আইনটির উপযোগিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে এবং তাঁরা এটির খোলনলচে বদলানোর পক্ষে, যা অদূর ভবিষ্যতে ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পর্কে আইনের ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করিয়া দায়িত্ব পালন করিবে এবং এই আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করিয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করিবে।’

এই আইনটির ভূমিকায় ‘যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম’ বিবেচনা করার কথা উল্লেখ করা থাকলেও অনুসন্ধান কমিটি কীভাবে সেটা যাচাই করবে, সে সম্পর্কে কিছু বলা নেই। অর্থাৎ সেটা যাচাইয়ের স্বচ্ছ পদ্ধতি আইনে নেই। এ বিবেচনায় এই আইনটি অগ্রহণযোগ্য। স্বচ্ছতা পরিমাপের একটা মানদণ্ড বা নিক্তি তো রয়েছেই। সেটা হলো জনগণকে আস্থায় নিতে হবে। অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ করা প্রার্থীদের ব্যাপারে জনগণের সরাসরি মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। এ জন্য গণশুনানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেটাই স্বচ্ছতা নিরূপণের সবচেয়ে কার্যকর নিক্তি।

সৎ, যোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনারদের খুঁজে বের করার জন্য অনুসন্ধান কমিটিকে দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, বাছাই করা নাম থেকে একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করে গণশুনানির ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, গণশুনানি ও যাচাইয়ের ভিত্তিতে যে ১০ জনের নাম তারা চূড়ান্ত করবে, কোন কোন যুক্তিতে তাদের নাম সুপারিশ করা হলো, সেটার একটা ব্যাখ্যা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। গত অনুসন্ধান কমিটির সদস্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ২০১৭ সালে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গণশুনানির প্রসঙ্গটি জোরালোভাবে উত্থাপন করেছিলেন। অনেক দেশেই এটা হয়। মানুষের সুনাম যাচাই করার একটা কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে তাঁর সম্পর্কে কী জনশ্রুতি আছে, সেটা যাচাই করা। ২০১২ সালে প্রথম অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। জনগণের আশা, সেখানে প্রতারিত হয়েছিল। এরপর ২০১৭ সালের অনুসন্ধান কমিটির অভিজ্ঞতা নেতিবাচক। নতুন অনুসন্ধান কমিটিও যদি আগের কমিটিগুলোর কার্যপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কার্যপদ্ধতিতে কাজ না করে, তবে পুরোটাই হবে পণ্ডশ্রম।

জনগণের সামনে আগে থেকে প্রকাশ করা না হলে বা গণশুনানি না হলে বোঝার তো কোনো উপায় নেই অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশেই রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দিচ্ছেন নাকি সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে নিয়োগ দিচ্ছেন। আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে একটি আইনের খসড়া দিয়েছিলাম। তাতে সুস্পষ্ট করে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনারদের নাম সুপারিশ ও নিয়োগের সুপারিশ করেছিলাম। যদিও যথাযথ একটা নির্বাচন কমিশন আইনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু বাস্তবে অতীত প্রজ্ঞাপনের ওপরই নতুন আইনের প্রলেপ বসানো হয়েছে।

অনুসন্ধান কমিটির ওপর গুরুদায়িত্ব বর্তেছে। নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থা ফেরাতে গেলে একটা সৎ, দক্ষ, প্রজ্ঞাবান ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। এ দায়িত্ব ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করা দুরূহ। আইন বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন, অনুসন্ধান কমিটির কাজের সময় বাড়ানোর সুযোগ কীভাবে করা যাবে। আমরা প্রস্তাব করেছিলাম, অনুসন্ধান কমিটির মেয়াদ এক থেকে দেড় মাস হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন

অনুসন্ধানের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য সম্ভাব্য ব্যক্তিদের নাম আহ্বান করা। অনুসন্ধান কমিটি প্রথম বৈঠকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নাম আহ্বান করেছে। আইনের ৩(৩) ধারায় বলা আছে, অনুসন্ধান কমিটি ‘রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নিকট হইতে নাম আহ্বান করিতে পারিবে।’ এই ধারা থেকে সুস্পষ্ট, কমিটি অন্যদের কাছ থেকেও নাম আহ্বান করতে পারবে। রাজনৈতিক দলের তালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়ার ঝুঁকি হলো কে কার নাম প্রস্তাব করছে, তা জানাজানি হলে (যা বাস্তবে হবেই) নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে, অনেক ক্ষেত্রে অযাচিতভাবেই, দলীয় সংশ্লেষের অভিযোগ উঠতে পারে।

সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য যে সুপিরিয়র যোগ্যতা অপরিহার্য, তা হলো ব্যক্তির সততা ও সুনাম। জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন নিরপেক্ষতা, সাহসিকতা ও প্রজ্ঞা-সম্পর্কিত সুনাম। আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভর করছে সৎ, দলনিরপেক্ষ, বিচক্ষণ ও মেরুদণ্ডসম্পন্ন নির্বাচন কমিশন গঠনের ওপরে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)