নির্বাচন কমিশনের পরিভাষা আবিষ্কারের তুঘলকি কাণ্ড

নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কতগুলো নামশব্দ বদলের উদ্যোগ নিয়েছে। এই বদলের জন্য তারা যেসব যুক্তি দেখিয়েছে, তার প্রশাসনিক দিক আছে, আবার ভাষাগত ও পারিভাষিক দিকও আছে। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘নির্বাচন কমিশনের নামবদলের অভিযান’ শিরোনামে তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে তাঁর মত জানিয়েছেন। তাতে তিনি নামবদলের নানান অসুবিধাসহ এর প্রশাসনিক সংকটগুলো তুলে ধরেছেন। এ লেখায় আমরা দেখাব, ভাষা ও পরিভাষার ধারণার দিক থেকেও এ পরিবর্তন-প্রস্তাব সংকটপূর্ণ নয় কেবল, বিপজ্জনকও বটে। কারণ, সুপারিশমালায় যে যুক্তি দেখানো হয়েছে, সেগুলো ভাষা ও পরিভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাকেও সমর্থন করে না।

পুরো দলিল তৈরি হয়েছে ভাষা-সম্পর্কিত দুটি ধারণার ওপর ভিত্তি করে। একটি হলো ‘খাঁটি’ বাংলা, আরেকটি ‘বিদেশি’ শব্দ। দুটিই খুব গোলমেলে ধারণা। দুনিয়ার কোনো ভাষাই খাঁটি নয়, বিশুদ্ধ নয়, হতে পারে না। ভাষা সব সময়ই একটা মিশ্র অস্তিত্ব। কাজ চালানোর জন্য প্রমিত বা মান–ভাষার একটা ধারণা ব্যবহার করতে হয় এ কারণেই। প্রমিত ভাষা ভাষার কোনো ‘শুদ্ধ’ বা ‘খাঁটি’ রূপ নয়, একটা নির্দিষ্ট সময়ে স্থির করা কেজো রূপমাত্র। সেই প্রমিত রূপসহ ভাষার যেকোনো রূপই মিশ্ররূপ। মিশ্রণসহই বাংলা ভাষা একটি ‘সমৃদ্ধ’ ভাষা, কোনো ‘খাঁটি’ রূপে নয়। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের সুপারিশে যে ‘খাঁটি’ বাংলার সন্ধান করা হয়েছে বা বরাত দেওয়া হয়েছে, তা ভাষাবিজ্ঞানসম্মত ধারণা নয়।

অন্যদিকে, ‘বিদেশি’ শব্দের ধারণাও ভাষার ক্ষেত্রে একটি কুসংস্কারমাত্র। বাংলা ব্যাকরণে বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় শব্দটি যুক্ত হয়েছিল। ব্যাকরণগত দিক থেকে ধারণাটি যে গ্রহণযোগ্য নয়, তার অন্যতম প্রমাণ এই যে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত সর্বশেষ ব্যাকরণে শব্দের এ ধরনের শ্রেণিবিভাগের কোনো আলোচনাই রাখা হয়নি। যদি ধরেও নিই, ‘বিদেশি’ শব্দ বলে একটা বর্গ আছে, তাতেও প্রমাণিত হয় না, এগুলো বাংলা শব্দ নয়। কারণ, পুরোনো ব্যাকরণে ‘বিদেশি’ শব্দ বাংলা শব্দের শ্রেণিবিভাগেরই অংশ, বাইরের কিছু নয়। উল্লেখ্য, যে শব্দগুলো ‘বিদেশি’ বা ‘বিজাতীয়’ অভিধায় নির্বাচন কমিশন বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, তার প্রায় প্রতিটি বাংলা একাডেমির বহু প্রচলিত ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ এবং ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ সংকলিত হয়েছে। বাংলা অভিধানে সংকলিত হওয়া মানেই হলো এগুলোকে অভিধান কর্তৃপক্ষ বাংলা শব্দ হিসেবেই বিবেচনা করেছে। এ-সম্পর্কিত আরও গভীর কোনো আলোচনায় না গিয়েই তাই নিশ্চিত করে বলা যায়, ‘বিদেশি’ শব্দের যে যুক্তি শব্দগুলো বাদ দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন ব্যবহার করেছে, তাতে ভাষাজ্ঞানের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।


এবার আসা যাক পরিভাষা প্রসঙ্গে। যে শব্দগুলো পরিবর্তনের কথা উঠেছে, এগুলো পারিভাষিক শব্দ। পারিভাষিক শব্দ সম্পর্কে গোড়ার কথা হলো ভাষা ও পরিভাষা এক বস্তু নয়; বরং ভাষার বৈশিষ্ট্য পরিভাষায় সঞ্চারিত হলে তা পরিভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় না। পরিভাষা আসলে ‘বাংলা’, ‘ইংরেজি’ প্রভৃতি ভাষার ব্যাপারই নয়, এটা বিশেষ ডিসিপ্লিন, বিষয় বা চর্চার ব্যাপার। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিভাষা জনজীবনে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন টেলিভিশন, রেডিও বা কম্পিউটার। নির্বাচন কমিশন যে পরিভাষাগুলো বদলাতে চায়, সেগুলো এই গোত্রের। এখন ‘টেলিভিশন’ বা ‘কম্পিউটার’কে ইংরেজি শব্দ হিসেবে বিবেচনা করে যদি এর ‘বাংলা’ করার প্রস্তাব করা হয়, তাহলে তা হবে হাস্যকর উদ্যোগ। কারণ, এক. এগুলো সব বাংলাভাষীর মুখে ব্যবহৃত হয়ে ‘বাংলা’ হয়ে গেছে। দুই. বাঙালি এ শব্দগুলো উচ্চারণ করে বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব অনুযায়ী, যে কারণে অন্য ভাষার একই শব্দের উচ্চারণের সঙ্গে বাঙালির উচ্চারণের পার্থক্য আছে। তিন. এই প্রচলিত শব্দগুলো বাদ দিয়ে ‘বাংলা’ প্রতিশব্দ খোঁজা মানেই হলো অপরিচিত বানানো শব্দ আমদানি করা, যা জনগোষ্ঠীর জন্য জুলুম এবং ভাষার স্বভাববিরোধী। ভাষা মুখ থেকে কলমে আসবে, কলম থেকে মুখে নয়। সুযোগ থাকলে, অর্থাৎ লোকপ্রচলিত শব্দ হাজির থাকলে এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটানো অন্যায়। নির্বাচন কমিশন যে শব্দগুলো বদলের প্রস্তাব করেছে, তার সব কটির ক্ষেত্রে এ সূত্রগুলো প্রযোজ্য।

‘মেয়র’, ‘প্রেসিডেন্ট’, ‘চেয়ারম্যান’ প্রভৃতি শব্দ বাংলা পড়তে জানা যেকোনো লোকই পড়তে পারবে এবং বুঝতে পারবে। কিন্তু এর বদলে যদি ‘আধিকারিক’ বা ‘পুরাধ্যক্ষ’-এর মতো কোনো শব্দ চালু করার চেষ্টা হয়, তাহলে তা কষ্ট করে পড়তে পারলেও এক বর্ণও বুঝতে পারবে না। বস্তুত, এ দুই শব্দ ‘বাংলা’ শব্দই নয়। যদি চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং বহুদিন ধরে ব্যবহৃত হতে থাকে, তাহলে একসময় হয়তো বাংলা শব্দ হয়ে উঠবে।

আবার পুরো আলাপ ‘ভাষা’ কিংবা ‘ভাষার সাধারণ শব্দ’ নিয়ে নয়, পরিভাষা নিয়ে। সেদিক থেকে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত শব্দগুলো বিচার করতে হবে। ‘ইউনিয়ন’-এর বদলে প্রস্তাব করা হয়েছে ‘পল্লি’ শব্দটি। বলা হয়েছে, শব্দটি বহুল প্রচলিত। কথা সত্য। কিন্তু শত বছর ধরে নির্দিষ্ট অর্থে প্রচলিত অর্থাৎ পরিভাষা হিসেবে প্রচলিত ‘ইউনিয়ন’ শব্দের তুলনায় ‘পল্লি’ কথাটা বেশি প্রচলিত কি না, তা প্রমাণসাপেক্ষ। যদি প্রচলিত হয়ও, প্রশ্ন উঠবে, কোন অর্থে প্রচলিত। বাংলা ভাষার শব্দ হিসেবে ‘পল্লি’ কথাটার ব্যবহার আর স্থানীয় সরকারের পরিভাষা হিসেবে প্রস্তাবিত ব্যবহারে বিস্তর ফারাক। বস্তুত, এ দুই ধারণা সম্পূর্ণ আলাদা। একই কথা ‘মহল্লা’র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ‘মহল্লা’ প্রচলিত শব্দ বটে। কিন্তু প্রশাসনিক একক হিসেবে নয়। প্রশাসনিক একক হিসেবে ব্যবহার করলে শব্দটির বহুমাত্রিক রূপান্তর ঘটবে। তা হবে নতুন করে পরিচিত হওয়ার মতো শব্দ।

আগেই বলেছি, ভাষার শব্দ আর পরিভাষা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস, এ কথা মনে না রাখলে এই আলাপ অর্থহীন হবে। নতুন শব্দ পরিভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যায় না, এমন নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন করব? ‘বিদেশি’ শব্দ বলে? তা তো অযৌক্তিক। কারণ, শব্দগুলো বাংলা। বাংলা অভিধানেই আছে। আর মানুষের কাছে অতি ব্যবহারে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন সুপারিশমালায় যুক্তি দিয়েছে, সাধারণ মানুষ ইংরেজি বর্ণ জানে না বলে শব্দগুলো উচ্চারণ করতে অসুবিধা হয়। ভুল যুক্তি। তারা ভাষার সাধারণ শব্দের সঙ্গে পরিভাষাকে গুলিয়ে ফেলেছে। সাধারণ নিরক্ষর মানুষ ইংরেজি বর্ণের মারফত শব্দগুলো শেখেনি। শব্দগুলো মুখে প্রচলিত পরিভাষা হিসেবে জেনেছে। আর শব্দগুলোর সঙ্গে ইংরেজি বর্ণেরও কোনো সম্পর্ক নেই।

দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যে শব্দগুলো বদলের কথা বলছে, সেগুলো পরিচিত ও অভিধানভুক্ত বাংলা শব্দ। আর যে শব্দগুলো চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলোর একাংশ পরিচিত-প্রচলিত বাংলা শব্দ হলেও পরিভাষা হিসেবে অচলিত, আর প্রস্তাবিত শব্দগুলোর একাংশ রীতিমতো ‘অ–বাংলা’। যদি কোনো উপকার হতো, যদি বহুজন দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানাত, যদি কোনো ধরনের প্রশাসনিক প্রয়োজন দেখা দিত, তাহলে এই ক্ষতি সহ্য করার কথা বিবেচনা করা যেত। কিন্তু এর কোনোটাই নয়। একেবারেই ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা জনভোগান্তি ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনবে না। একজন নাগরিক হিসেবে এই অযৌক্তিক ও ক্ষতিকর প্রস্তাব প্রত্যাহারের আবেদন জানাই।


মোহাম্মদ আজম: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।