নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় কেমন হলো!

জাতীয় পত্রপত্রিকার সাংবাদিক ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময়
জাতীয় পত্রপত্রিকার সাংবাদিক ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময়

সভাকক্ষের সামনে টেলিভিশন সাংবাদিকেরা ক্যামেরা তাক করে রেখেছেন। দ্রুত সভাকক্ষে ঢোকা গেল।

ভোরের কাগজ-এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেই ফেললেন, ভবনটা তো চমৎকার, কিন্তু আসল কাজটা…আর বললেন না। মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী খানিক পরে বললেন, ‘সেদিন শাহরুখ খানের একটা সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। বলিউড বাদশাহ বললেন, মনের সব কথা বলে ফেলতে নেই। যদি বলতেই হয়, স্নানের ঘরে গিয়ে আয়নার সামনে বলুন।’

আমরা এসেছি নির্বাচন কমিশনের দাওয়াত পেয়ে। নির্বাচন কমিশন জাতীয় পত্রপত্রিকার সাংবাদিক ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে সুন্দরভাবে, সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়, সে জন্য তারা বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করছে। এর আগে তারা কথা বলেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনার এসে আসন গ্রহণ করলেন। শুরুতেই নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব ভূমিকা পাঠ করলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সবাইকে স্বাগত জানালেন।

আমাদের আরেক বন্ধু নঈম নিজাম সবচেয়ে স্মার্ট। বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সম্পাদক। নিউজ ২৪-এর সিইও। তিনি আগেই বলে রেখেছেন, তিনি ব্যস্ত, তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে তাঁকে, কাজেই সবার আগে তিনি বলবেন। নঈম নিজাম প্রথমেই বর্তমান কমিশনকে অভিনন্দন জানালেন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ভালো হয়েছে। এরপর বললেন নির্বাচনী সীমানা সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে। তাঁদের এলাকা কুমিল্লায় একটা আসন কুমিল্লা থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার লম্বা, এই ধরনের অসংগতি দূর করা প্রয়োজন।

আলোচনা কোন অর্ডারে চলবে, একটা নিয়ম করা হলো। একধার থেকে প্রত্যেকে বলবেন, একবার এই পাশ, আরেকবার ওই পাশ থেকে। প্রত্যেকের সময় তিন মিনিট।

মাহবুব কামাল আমার আরেক বড় ভাই। এখন যুগান্তর-এর সহকারী সম্পাদক। তিনি বলতে শুরু করলেন ইংরেজিতে। নানা ধরনের প্রবাদ-প্রবচন দিয়ে তিনি বক্তব্য শুরু করেছেন। বলছেন, দুনিয়ায় কোনো কিছুই পারফেক্ট নয়। পুরো পারফেক্ট কেউ হতে পারবে না। পারসেপশন হলো আসল। নির্বাচন কমিশনকে জনমনে এই ধারণা দিতে হবে যে তারা ভালো নির্বাচন করতে চায়।

আমরা নাঈমুল ইসলাম খানকে দায়িত্ব দিয়েছি তিন মিনিট পর সংকেত বাজানোর। সংকেত বেজে উঠতেই মাহবুব কামাল বললেন, আমাকে আগে থেকে সময় বেঁধে দিলে তো আমি তিন মিনিটেই শেষ করতাম। এখনো তো আসল কথা শুরুই করিনি। মাহবুব কামাল আসল বক্তব্য শুরু করলেন। সেনা নিয়োগের দরকার নেই। না-ভোট প্রবর্তন করতে হবে। কারণ, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো ভালো প্রার্থী দেওয়ার চাপ অনুভব করবে। প্রার্থী খারাপ হলে না-ভোট পড়বে, তাতে নাগরিকদের একটা মত নেতাদের জানান দেওয়া যাবে। ভালো নির্বাচনের চারটা বাধা। এক. খারাপ প্রার্থী, দুই. অতি উৎসাহী যুদ্ধংদেহী কর্মী-সমর্থক, তিন. প্রশাসনের দলীয়করণ, চার. ফল প্রকাশে কারচুপি। এই চারটা দূর করতে পারলে নির্বাচন ভালো হবে।

কালের কণ্ঠর নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল দুটো স্পষ্ট ভালো প্রস্তাব পেশ করলেন। জোটের প্রার্থী হলেও তাঁকে দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। আর আইনে ও সংবিধানে কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে।

দৈনিক যুগান্তর-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম বললেন, বিশ্বাসের জায়গা, আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে কমিশনকে। নির্বাচনী ব্যয় ২৫ লাখ টাকার বেশি হতে পারবে না, এই নিয়ম কি কেউ মানে?

বিভুরঞ্জন সরকার খুবই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ভোটের আগে, ভোটের সময় ও ভোটের পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়। যে নির্বাচন ভালো হয়েছে মনে করা হয়, তখনো সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছে, যে নির্বাচন ভালো হয়নি, সেবারও সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়। তাঁরা ভোট দিলে আক্রান্ত হন, ভোট না দিলেও নির্যাতনের শিকার হন।

শ্যামল দত্ত বলেন, আসল কাজ হলো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। সব রাজনৈতিক দল, খোলাখুলি বললে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য সব দলের আস্থা অর্জন করতে হবে, বিএনপির আস্থা অর্জন করতে হবে। নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এ কথা মোটামুটি অনেকেই বলেছেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেছেন সবাই।

নির্বাচনের মাঠে সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকবে কি থাকবে না, এই প্রশ্নে আলোচকেরা একমত ছিলেন না। কেউ বলেছেন, না, থাকা উচিত নয়। নির্বাচন, কমিশন—এসব সিভিল বিষয়, এতে সেনাবাহিনী আসবে কেন? কেউ বলেছেন, যেমন মতিউর রহমান চৌধুরী, আমাদের সেনাবাহিনী সারা পৃথিবীতে শান্তি রক্ষা করে, অন্য দেশে নির্বাচনে কর্তব্য পালন করে, বাংলাদেশে পারবে না কেন?
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, খেলার মাঠে আম্পায়ারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ম্যারাডোনাকেও লাল কার্ড দেখানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে দরকার হলে লাল কার্ড দেখাতে হবে। যদি মাগুরার নির্বাচনটা তৎকালীন কমিশন বাতিল করে দিত, আজ ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

ইত্তেফাক-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আশিস সৈকত খুব একটা বাস্তব পরামর্শ দিয়েছেন ঋণখেলাপি বিষয়ে। বলেছেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে সার্টিফিকেট এনে, আদালতের রায় এনে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়। এই বিষয়ে অন্তত ১৫ দিন আগে নিজেকে ঋণখেলাপি নন, প্রমাণ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা দরকার।

যেমন সাংবাদিকদের প্রায় সবাই বলেছেন, রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে রাখুন। এই জন্য হলফনামা প্রকাশ করুন। হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থিতা এবং সংসদ সদস্য পদ বাতিল করার বিধান রাখুন। সরকারি কর্মকর্তারা পদত্যাগ/অবসরের তিন বছরের মধ্যে প্রার্থী হতে পারবেন না, সেটা কঠোরভাবে মানবেনই, বরং এটাকে পাঁচ বছর করুন। বিএফইউজের মহাসচিব ওমর ফারুক শেষের ব্যাপারটিতে জোর দেন। আর সংবাদ-এর মুনীরুজ্জামান জোর দিলেন হলফনামা অনলাইনে প্রকাশিত রাখার ওপরে। প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন ছিলেন একমাত্র নারী সাংবাদিক। তিনি বললেন, রাজনৈতিক দলগুলো যাতে বেশি করে নারীদের মনোনয়ন দেয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

নাঈমুল ইসলাম খান রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের জন্য জেলা প্রশাসকের বাইরে দক্ষ ও নিরপেক্ষ কর্তাদের একটা বড় তালিকা প্রণয়ন করে সেখান থেকে ৬৪ জনকে নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। আমানউল্লাহ কবীর জোর দেন আস্থা অর্জনের ওপর। নূরুল কবির জাতিগত সংখ্যালঘু আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন। আর তিনি বলেন নিজেকে ভালোবাসার কথা, নিজের মর্যাদাকে ভালোবাসার কথা। এই কমিশন কি মর্যাদা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে চায়, নাকি চায় না। আইনে সব আছে, আত্মমর্যাদার সঙ্গে তা প্রয়োগ করতে পারতে হবে—নূরুল কবিরের মত।

সোহরাব হাসান বলেন, নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম, বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার আর বাসসের ভূমিকা কী হবে?

মাহফুজ উল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বলেন, সামনে তিনি কোনো বিতর্কিত নির্বাচন চান না, তখন মানুষের মধ্যে একটা আগ্রহ ও আস্থার ভাব দেখা দেয়।

বিএফইউজের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বললেন, হলফনামায় সংবাদমাধ্যমের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি না-ভোটের বিপক্ষে, কারণ, এটা থাকলে ঘৃণা-বিদ্বেষের প্রচার বাড়বে। আর সেনাবাহিনী নিয়োগের ব্যাপারটা তিনি মনে করেন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার, তবে সিভিল আয়োজনে সামরিক বাহিনীর দূরে থাকাই কাম্য।

আর বিএফইউজের আরেক অংশের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল্লাহ বললেন, যে সংবাদমাধ্যম এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেসবের ভাগ্যে কী হবে।

প্রথমে ঠিক করে রেখেছিলাম, কিছুই বলব না।

তবে একে একে প্রত্যেকের বলার পালা আসছে, আমারও এল, তাই যা বললাম বা বলতে চেয়েছিলাম তা হলো, আমরা এমন একটা নির্বাচন চাই, যাতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সবাই অংশ নেবে, আমরা নাগরিকেরা সবাই নির্ভয়ে উৎসবের মতো করে ভোট দিতে যাব। যাকে পছন্দ করি, তাকেই ভোট দেব। আমার সেই ভোট গণনার মধ্যে থাকবে এবং ভোটের ফলে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটাবে। তা করতে হলে আস্থা অর্জন করতে হবে। তার একটা লিটমাস টেস্ট হতে পারে সামনের সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ, ভোট দিয়েই আমরা সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠা করি, ভোট না দিতে পারলে তো প্রজাতন্ত্রের মৌলিক প্রত্যয়ই প্রতিষ্ঠা পায় না।

কেন আমি ভাবছিলাম, কিছুই বলব না। আসলে নির্বাচনটা হয় ভালো হবে, না হলে খারাপ হবে। যদি নির্বাচন ভালো হয়, তাহলে ‘না-ভোট’ আছে কি না, হলফনামা পুরোপুরি মানা হলো কি না, সীমানা দুই-চারটা আসনে আরও ভালো করা যেত কি না—এগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাবে; যদিও এগুলো বড় ফ্যাক্টর হবে না। আর যদি নির্বাচন খারাপ হয়, একপক্ষীয় হয়, ভোটারবিহীন হয়, তাহলে ‘না-ভোট’ ছিল কি না, পোস্টারের দুই রং মানা হয়েছিল কি না—এগুলো কোনোটাই তখন কোনো ব্যাপার হয়ে দেখা দেবে না।

ভোট ভালো হবে কি হবে না, এটা আমাদের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে বড় রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের সদিচ্ছার ওপর। তারা যখন তাদের চাওয়াকে পাওয়া বানানোর চেষ্টা করবে, তখন আমাদের মতো সংবাদকর্মীদের বক্তব্য খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে?

তাহলে কি আমরা কথা বলব না?

এইখানে আমি রবীন্দ্রনাথের জোনাকি নিয়ে রচিত গানটা স্মরণ করি। জোনাকি যতটুকুন সাধ্য আছে, তা দিয়েই আলো জ্বালে। সে সূর্য বা চাঁদের মতো নয়, তবু তো সে আলো জ্বালে। আমরা জানি, সূর্য উঠলে জোনাকির আলোর কোনো দামও নেই, দরকারও নেই, তবু তার কাজ তাকে করে যেতেই হয়। আমরাও তা-ই করি। আমাদের কথা আমরা বলেই যাব।

এখন অন্তত একটা প্রশ্নের জবাব দিই, যাতে এত দীর্ঘ লেখা পড়ার পর আপনার মনে না হয় যে কিছুই তো নেই।

প্রশ্ন: নির্বাচনের সময় কি এগোতে পারে?

উত্তর: কমিশনের রোডম্যাপ অনুযায়ী তা হওয়ার কথা নয়। নির্বাচন ২০১৮-এর শেষে বা ২০১৯-এর শুরুতে হওয়ার কথা—এখনো পর্যন্ত।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।