প্রথম আলোর ৩০ ডিসেম্বরের ‘মতামত’ পাতায় নির্বাচন ও রাজনীতির ওপরে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লিখিত ‘কী দেখলাম, কী দেখব’ নিবন্ধটি পড়লাম। তাঁর সুচিন্তিত ও সুলিখিত বক্তব্যে বাস্তবিকই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে। আশা করি তাঁর মতামত ও পরামর্শ জাতি যথাযথ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে এবং তা মঙ্গলদায়ক হবে।
নিবন্ধটিতে আমার সম্পর্কে কতিপয় মন্তব্য রয়েছে। সত্য প্রতিষ্ঠার তাগিদে প্রকৃত তথ্য পরিবেশন করে সেগুলোর ওপর আলোকপাত বাঞ্ছনীয় মনে করি। ‘মনোনয়ন না পেয়ে’ আমি দল ছেড়ে চলে গেছি, এটা পুরো সত্য নয়, আংশিক সত্য। সম্পূর্ণ মনোনয়ন–প্রক্রিয়াই আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ঠেকেছে এবং নীতিগতভাবে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। বস্তুতপক্ষে দলটিতে উঁচু পদমর্যাদায় প্রায় দুই দশক আসীন থেকেও প্রার্থী হয়ে তিনটি সাধারণ নির্বাচনে আমি দলের মনোনয়নপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। যার কারণ এখনো আমার বোধগম্য হয়নি। এ যে আমার প্রতি দলের বিশ্বাস ও আস্থার দুঃখজনক অনুপস্থিতি, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে মত ও পথের পার্থক্য এর জন্য দায়ী কি না, তা আমি জানি না। তবে আরও কিছু ঘটনা সে ধারণাকে বদ্ধমূল করেছে। তৎকালীন চলমান প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক ফলাফল ব্যক্তিগত ও আদর্শিকভাবে আমার জন্য যে পরম বিব্রতকর, অবমাননামূলক ও নিরাশাব্যঞ্জক এবং পার্টির সঙ্গে আমার সম্পর্কের সম্ভাব্য পরিণতির বিষয়ে আমি মৌখিকভাবে দলের উচ্চপদাসীন নেতাদের ওয়াকিবহাল করেছিলাম। যেখানে আস্থা ও বিশ্বাসের অনুপস্থিতি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মত ও পথের দৃশ্যমান পার্থক্য, সেখানে সহাবস্থান সম্ভব নয়। জীবনের তরি তখন এক বন্দর থেকে নোঙর তুলে অন্য বন্দরে আশ্রয় নেবে বৈকি। আর সে চয়ন-ক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা সৃষ্টির আহ্বান অবশ্যই কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।
অধ্যাপক চৌধুরী ‘সুবিধা’ লাভের ইঙ্গিত করেছেন। বস্তুতপক্ষে পরিদৃশ্যমান বা আশু ‘সুবিধা’ লাভ যে দলত্যাগের কারণ ছিল না, তা অনুধাবন করা যেতে পারে। এ কারণে যে নতুন দলে যোগদানের সময় মনোনয়নপ্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। মনোনয়ন প্রদানের চূড়ান্ত ক্ষণ আগেই গত। সুতরাং মনোনয়ন লাভের সুবিধা অর্জন এই দল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অবশ্য এই সাধারণ নির্বাচনের আগে কয়েকটা দলবদলের ঘটনা ঘটেছে বটে, যেখানে নতুন দলে মনোনয়নপ্রাপ্তি ছিল প্রায় সুনিশ্চিত।
অধ্যাপক চৌধুরীর আরেকটি মন্তব্যের বিষয়ে প্রকৃত তথ্য সম্পর্কে আমি আলোকপাত করতে চাই। তিনি লিখেছেন, আমি যখন প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলাম, তখন ওই সংস্থার ‘প্রধান কীর্তি আদমজী পাটকলের বিলোপ সাধন।’ বস্তুতপক্ষে আদমজী পাটকল প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের ব্যবস্থা গ্রহণের আওতায় বা তালিকায় কখনো ছিল না। ওই পাটকলের বিলুপ্তি বা অন্য কোনো রূপান্তরে আমার কমিশনের বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা ছিল না। এমনকি ওই পাটকলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণী কোনো আলোচনায়ও আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, বিষয়টির নিষ্পত্তি অর্থ ও পাট মন্ত্রণালয়ের (এবং সম্ভবত শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও) সমন্বিত উদ্যম ও উদ্যোগে করা হয়েছিল।
আমার নেতৃত্বাধীন প্রাইভেটাইজেশন কমিশন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানেরই বিলোপ ঘটায়নি। সরকার কর্তৃক চিহ্নিত বিপুল ক্ষতি সাধনকারী লোকসানি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে (যেগুলো সুপরিচালিত হলে লাভজনক হওয়ার কথা) একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করা হয়েছে মাত্র। সব ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত টেন্ডারে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ মূল্য প্রদানকারী বকেয়া ঋণসমেত তা ক্রয় করেছেন। সব ক্ষেত্রেই প্রদত্ত মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফ্লোর-প্রাইজের ওপরে ছিল এবং সরকারের ‘রক্তক্ষরণ’ বন্ধ করার জন্যই সরকার এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। এটা সগর্বে বলা যায় যে যথারীতি এই বিক্রয়গুলো কোনো ক্ষেত্রেই সামান্যতম প্রশ্নবিদ্ধও হয়নি। ‘ওই প্রাইভেটাইজেশন সবকিছু খেয়ে ফেলেছে’, এই মন্তব্য আমার কমিশন সম্পর্কে মোটেই প্রযোজ্য নয়।
আদমজী পাটকলের বিলোপ সাধন থেকে এই উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে, ‘তাঁর (অর্থাৎ আমার) কাছে প্রাইভেটই আসল বিবেচ্য, পাবলিক হচ্ছে প্রাইভেটের জন্য ব্যবহার্য এজমালি সম্পত্তি’ মোটেই যুক্তিসংগত ও সত্যনিষ্ঠ নয়। আদমজী পাটকল বিলোপ সাধনে কমিশনের বা কমিশনের চেয়ারম্যান (অর্থাৎ আমার) কোনো দায়দায়িত্ব, এমনকি ন্যূনতম সম্পর্কই ছিল না। তাই ওই ব্যাপারে কোনো মন্তব্যই এখানে প্রযোজ্য নয়।
অগ্রজপ্রতিম অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমার অতীব শ্রদ্ধাভাজন। পরিবেশিত কিছু ভ্রান্ত তথ্যের ওপর নিজের অজ্ঞাতেই নির্ভর করে তিনি ওই মতামতগুলো প্রকাশ করেছেন বলে আমার বিশ্বাস। নিরুপায় হয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমার কথাগুলোর অবতারণা করতে হলো বলে আমি নিজেও দুঃখবোধ করছি।
ইনাম আহমদ চৌধুরী, সাবেক সচিব
আরও পড়ুন:
‘কী দেখলাম, কী দেখব’