নির্বাচনী ব্যবস্থায় আস্থাহীনতা ও ‘রাওয়া’ পরিস্থিতি

২৪টি পৌরসভার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এই নির্বাচনগুলোই হতে যাচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বড় আকারের শেষ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ বাকি আছে আর এক বছরের কিছু বেশি। এরই মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের মধ্যে পড়েছে বর্তমানের নূরুল হুদার নেতৃত্বের নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে, বিশেষ করে নির্বাচনী ইতিহাসে, সব নির্বাচন কমিশন নিয়েই অল্পবিস্তর বিতর্ক হয়েছে। বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপনের আগে দুটি নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্র করেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে দারুণ উথালপাতাল হয়েছে।

এর একটি ছিল প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ১৯৯০-উত্তর বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফের সময়কালে। তাঁর নিষ্ক্রিয়তার কারণে মাগুরার (১৯৯৪) বহুল আলোচিত উপনির্বাচনের বিতর্কিত ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন, যা ওই সময়কার রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তীব্র বিতর্কের মুখে ওই সময়কার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি রউফ পদত্যাগ করে ফিরে যান হাইকোর্টের অ্যাপিলেট বিভাগে। তত দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক ইতিহাসের গতি পরিবর্তিত হয়।

মাগুরার নির্বাচনের পর থেকেই নির্বাচন কমিশন আলোচনা ও চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। পরবর্তী সময়ে বিশাল বিতর্কের মধ্যে পড়তে হয় বিচারপতি আজিজের কমিশনকে। এই কমিশন উল্লেখযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা না করলেও ভোটার তালিকাকে কেন্দ্র করে মানুষের অনাস্থার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে সম্পূর্ণ কমিশন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুরোধে পদত্যাগ করে। এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কমিশন, যাকে ব্যাপক জনরোষের মুখে পদত্যাগ করতে হয়।

ওই সময়ে বোধ করি বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা সর্বনিম্নে ছিল। এরপর নানা উদ্যোগ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর এই আস্থার সংকট অনেকটা কেটে যায় এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের নজরদারি জোরদার হয়। কিন্তু পরে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর আবার বিতর্কের মুখে পড়ে কমিশন। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচন, তার আগের সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য নির্বাচনের যে মাত্রায় অনিয়ম ও কারচুপি হয়েছে এবং তা দূর করতে কমিশনের অপারগতা ও অসহায়ত্ব বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থায় চরম ধস নামিয়েছে।

মাত্র কিছুদিন আগেই দেশের ৪২ জন অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। যার মধ্যে অর্থ কেলেঙ্কারির কথাও রয়েছে, রয়েছে অদক্ষতা আর কর্মহীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরের নির্বাচন কমিশনের অনেকগুলোর ওপর কর্মহীনতা ও নির্বাচনে সব ধরনের অব্যবস্থাপনার কমবেশি অভিযোগ আনলেও এ ধরনের অভিযোগ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো নাগরিক সমাজের শীর্ষ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের অভিযোগ করতে দেখা যায়নি। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার জবাবে নির্বাচন কমিশন বলেছে, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচন ও পরবর্তী বিভিন্ন নির্বাচনে নিয়ন্ত্রণহীনতার যে চাক্ষুষ প্রমাণ রয়েছে, তাতে নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের বক্তব্যকে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা দেখছি একদিকে গণতন্ত্রের প্রথম খুঁটি বলে আখ্যায়িত নির্বাচন চরম প্রশ্নের মুখে পড়েছে, অন্যদিকে জনমনে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর অভূতপূর্ব আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অতীত নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ও ভোট প্রদানের হার বিশ্লেষণ করলেই তার প্রমাণ মিলছে।

রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশন নিয়ে নাগরিকদের অভূতপূর্ব আবেদনে তিনি কী করবেন বা করবেন না, তা রাষ্ট্রপতির নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে ধারাবাহিকভাবে অস্বচ্ছ এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অবনতির কারণে জনগণ ভোট প্রদানের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, সরকারের ও সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা প্রয়োজন। আর এ সহযোগিতার পরিবেশও নির্বাচন কমিশনকে তৈরি করতে হবে।

২.

নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ক্রমেই অবনতির কারণে মানুষ নির্বাচন ও উদার গণতন্ত্র নিয়ে সংশয়ের মধ্যে রয়েছে। অপর দিকে আমলাতন্ত্রের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। প্রায়ই তথ্য প্রকাশিত হয়ে আসছে যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের, বিশেষ করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে, স্থানীয় সরকারবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে বরখাস্ত হতে হয়েছে, এটা কোনো গণতান্ত্রিক বিধান হতে পারে না।

এ পদ্ধতি থেকে বেসরকারি সংগঠনগুলোও বাদ পড়ছে না। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক পত্র দ্বারা সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের কল্যাণমূলক সংগঠন ‘রাওয়া’র (রিটায়ার্ড অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন) আগামী নির্বাচনের মাত্র সপ্তাহ আগে নির্বাচিত পরিষদ রদ করে নির্বাচিত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও বেভারেজ সদস্যকে বরখাস্ত এবং এবং সংগঠনের দায়িত্ব একটি ‘কেয়ারটেকার পর্ষদের হাতে দেওয়া হয়েছে’।

ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আগামী দিনে উপরিউক্ত তিনটি পদ ছাড়া বাকি পদে নির্বাচন হবে। এর মানে এ রকম একটি অ্যাসোসিয়েশনে দেশে প্রচলিত নিয়মে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণে পর্ষদের শিখরে বসানো হবে অনির্বাচিত মাথা। এমন ধরনের সিদ্ধান্ত রাওয়ার চার হাজারের ওপরে সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সদস্যকে মর্মাহত করেছে। এই সংগঠনে খুবই স্বচ্ছ পদ্ধতিতে দৃষ্টান্তমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। যখন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রশ্নের মুখে, ঠিক এ সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। যেসব কারণ দেখিয়ে এ কাজটি করা হয়েছে, সেখানেও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মানা হয়নি।

বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশের সরকারি ও বেসরকারি সব সংগঠন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলুক, সেটাই প্রত্যাশিত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রের লড়াইয়ে জীবনের অর্ধেক জেলে কাটিয়ে শত অত্যাচার সহ্য করে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতেই স্বাধীনতার বাহক হয়েছিলেন। নির্বাচন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে সব পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে আশা করি যে রাওয়ার মতো সংগঠনগুলোকে সরাসরি নির্বাচিত পরিষদ দ্বারা পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হবে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

[email protected]