নির্বিকার নির্বাচন কমিশন ও জবরদস্তির পৌর নির্বাচন

এই লেখাটি যখন পাঠকের হাতে পৌঁছাবে, তখন দেশের ৬০টি পৌরসভায় ভোট গ্রহণ চলবে। নির্বাচন কেমন হবে, তার আলামত কয়েক দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে। মারামারি কাটাকাটি প্রাণহানি সবই ঘটেছে একটি দলের ‘মনোনীত’ ও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের মধ্যে। অন্য দল মাঠেই নামতে পারেনি। শেষটা ভালো হবে, না মন্দ হবে, তা নির্ভর করছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের মর্জির ওপর।

এখানে নির্বাচন কমিশনের কার্যত কোনো ভূমিকা নেই। খোন্দকার মোহাম্মদ নূরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন নামে যে শিখণ্ডী প্রতিষ্ঠানটি আছে, নির্বাচন কিংবা ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ার ওপর তাদের  নিয়ন্ত্রণই নেই। তাদের দায়িত্ব হলো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের নামে বিশেষ সম্মানী ভাতা নেওয়া এবং ভোটকেন্দ্রে ভোটার আসুক বা না আসুক রাতের বেলা ফলাফল ঘোষণা করা। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম অথর্ব ও অক্ষম নির্বাচন কমিশন দ্বিতীয়টি আছে কি না সন্দেহ।

অতীতে দেখেছি, নির্বাচন কমিশন মাঝেমধ্যে সরকারি দলের খবরদারি ও জবরদস্তির বিরুদ্ধে কথা বলত। বর্তমান কমিশন টু–শব্দটুকুও করে না। এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা সুষ্ঠু নির্বাচনের চেয়ে চাকরি রক্ষাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তাঁদের সৌভাগ্য যে বিএনপির মতো দিশেহারা ও নেতৃত্বশূন্য দলটি এখন বিরোধী দলে আছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে তারা টের পেত কত ধানে কত চাল। আন্দোলনের মুখে আজিজ কমিশনের মতো অপমানজনকভাবে বিদায় নিতে হতো। বিচারপতি আবদুর রউফ ও বিচারপতি এম এ সাদেকও কিছুটা উপলব্ধি করেছেন। তবে এম এ আজিজের মতো নয়।

নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব কোনো দলকে ক্ষমতায় আনা বা ক্ষমতা থেকে নামানো নয়। তাদের কাজ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা—ভোটাররাই সিদ্ধান্ত নেবেন, কে ক্ষমতায় আসবেন, কে আসবেন না। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার পূর্বশর্তগুলো হলো যথাক্রমে:
১. প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা মাঠ সমতল রাখা, যাতে তাঁরা ভোটারদের কাছে গিয়ে নিজ নিজ কর্মসূচি তুলে ধরতে পারেন।
২. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা, যাতে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে।
৩. নির্বাচনের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করা, যাতে মানুষ নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।

ক্ষমতাসীনেরা সব সময়ই নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রশাসনকে ব্যবহার করে থাকেন বা করতে চান। এ কারণে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চাকরি নির্বাচন কমিশনের অধীনে নেওয়া হয়। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যে রূপ কর্মচারী প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেই রূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’
কিন্তু পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেই দায়িত্ব কতটা সুষ্ঠুভাবে পালন করছেন, তার দুটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি।

নির্বাচনের পদাধিকারীরা গরিব নন, তাঁরা হয়তো তিন কোটি টাকা পকেট থেকেও দিতে পারবেন। কিন্তু গত চার বছরে নির্বাচন কমিশন যে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন, তা দেবেন কীভাবে?

চতুর্থ ধাপে অনুষ্ঠেয় জয়পুরহাটের কালাই পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি থেকে দুজন প্রার্থী হতে আগ্রহী। স্থানীয় বিএনপি সমস্যাটি সমাধান করতে না পেরে জেলা কমিটির শরণাপন্ন হয়। জয়পুরহাট জেলায় বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। সমস্যা নিরসনে জেলা কমিটির আহ্বায়ক শামছুল হক মঙ্গলবার মনোনয়নপ্রত্যাশী দুই নেতাসহ জেলা বিএনপি, কালাই উপজেলা ও পৌর বিএনপির কয়েকজন নেতা-কর্মীকে ডাকেন তাঁর বাসায়। তাঁরা যখন সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা করছিলেন, তখনই পুলিশ হানা দিয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শামছুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল ওহাব, সদস্য আমিনুর রহমান, কালাই পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী আনিছুর রহমান তালুকদার, সোহেল তালুকদারসহ বিএনপির ২৩ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে।

জয়পুরহাট বিএনপির এক নেতা বলেছেন, পুলিশ আমাদের দলীয় কার্যালয়ে জড়ো হতে দেয় না। আবার বাসায় দলীয় নেতা-কর্মীরা বৈঠক করলে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। পুলিশের দাবি, বিএনপির নেতা-কর্মীরা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শামছুল হকের বাসায় বসে নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। এ সময় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

যে দলটির নেতা–কর্মীরা রাস্তায় বের হতে পারেন না, সেই দলের নেতা-কর্মীরা দলীয় নেতার বাসায় বসে নাশকতার প্রস্তুতি নেবেন, এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে কুলিয়ারচর পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত মেয়র প্রার্থী নুরুল মিল্লাত বলেছেন, কয়েক দিন ধরে অসংখ্য নেতা-কর্মীর বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায় এবং তাঁদের এলাকা ছেড়ে যেতে বলে। ভোটের আগে বাড়িতে না আসার কথা জানিয়ে আসে।

তাহলে স্থানীয় পর্যায়ের এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কী। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের অধীন নন, নির্বাচন কমিশনই তাঁদের অধীন হয়ে কাজ করছে।

আরেকটি উদাহরণ দিই। কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী এনামুল হকের ভিডিও ক্লিপ ফাঁস হওয়ার পরও নির্বাচন কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ৯ জানুয়ারি উপজেলার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মোশারফপুরে পৌর এলাকায় একটি নির্বাচনী সভায় তিনি বলেন, ‘ভোট ভয়ের কোনো ব্যাপার না, আমি যদি ওপেন সিল মেরে দিই, তাহলে কারও কিছু বলার নেই। সবাই নৌকায় সিল মেরে দেবেন প্রকাশ্যে, কোনো সমস্যা নাই, যেখানে সবাই একতরফা ভোট দেবে। সেখানে কেন আপনি সন্দেহের মধ্যে থাকবেন। তাই কাউন্সিলরের দুটি গোপন কক্ষে আর মেয়রের ভোটটি প্রকাশ্যে দেবেন, কাউকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
তাহলে আর নির্বাচনের কী দরকার। নির্বাচনের আগে তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করলেই কষ্ট করে ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে হয় না। কে এম নূরুল হুদা কমিশন এতটাই অথর্ব যে একজন প্রার্থী প্রকাশ্যে এ রকম ঘোষণা দেওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না।

নির্বাচন কমিশনের সাবেক কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন, আইনে নির্বাচন কমিশনকে বিস্তর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো নির্বাচন কমিশন সেই ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাবে কি না। ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই।

কী করে নির্বাচন কমিশন অন্যকে আইন মেনে চলার হুকুম দেবে, নিজেরাই যেখানে আইন মানছে না। সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনাররা যে বিশেষ বক্তার পদ তৈরি করে ‘বিশেষ সম্মানী’ নিয়েছেন, সরকারের অডিট আপত্তি অধিদপ্তর তাতে আপত্তি জানিয়েছে। তাঁরা বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন সদুত্তর দিতে না পারলে টাকা ফেরত দিতে হবে।’

এর আগে সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের হিসাব নিয়ে অনেক অডিট আপত্তি হলেও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের খরচ নিয়ে আপত্তি এই প্রথম।

নির্বাচনের পদাধিকারীরা গরিব নন, তাঁরা হয়তো তিন কোটি টাকা পকেট থেকেও দিতে পারবেন। কিন্তু গত চার বছরে নির্বাচন কমিশন যে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন, তা দেবেন কীভাবে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]